আতঙ্কের দাপটে অবহেলিত সতর্কতা
তাড়া দেওয়া হচ্ছে জলদি বাজারে যান। জিনিসপত্র ফুরিয়ে যাওয়ার আগে বাজারে যেতে বলা হচ্ছে। সুপারশপ, এলাকার কাঁচাবাজার, গলির মুদি দোকান সব নাকি খালি হয়ে যাচ্ছে। গলির যে মুদি দোকানি মাসে এক লাখ টাকা বেচতে পারত না, সেই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে তিন দিনে। সুপারশপে পণ্য কেনার যুদ্ধ। কার আগে কে ব্যাগ-ট্রলিতে উঠিয়ে নিতে পারে। মহল্লায় দেখছি অনলাইন শপের পিকআপ ঢুকছে একের পর এক। অফিসের সহকর্মীদের কেউ কেউ চেপে রাখতে রাখতেও স্বীকার করে নিচ্ছেন বাড়তি বাজারের কথা। কোভিড-১৯-এর মতোই সংক্রামক এক ভাইরাস এই হুজুগে বাজারে ঝাঁপ দেওয়া। কে কী কিনল সেই খবর পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকেও। ইনবক্স বা টাইমলাইনে তুলে দেওয়া হচ্ছে কী কী পণ্য কিনে রাখা জরুরি। ব্যস, সবাই মিলে বাজারে মহামারি লাগিয়ে দিল।
মহামারি চলছে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসাসেবা নিয়েও। দোয়া, থানকুনি পাতা থেকে নানা বদ্যির দাওয়াই, টোটকা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বেড়াচ্ছেন ফেসবুক, ইউটিউবের বাসিন্দারা। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে চিকিৎসকরাও অবস্থান করছেন। যিনি ফিজিওথেরারি, পুষ্টি বা চোখের চিকিৎসক বলে পরিচিত, তিনিও ভাইরোলজির এই জটিল চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে কয়েক লাইন, কয়েক মিনিটের বাক্য তুলে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হয়তো ব্যবস্থাপত্রটি মোটেও সংক্রমণ থেকে রক্ষা বা মুক্তির সহায়ক নয়; বরং আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে। এ ধরনের শত শত ব্যবস্থাপত্র ‘সহভাগ’ হচ্ছে ফেসবুক দুনিয়ায়। কোনো কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সেবিকা ও চিকিৎসক নিজেরাই আতঙ্ক প্রকাশ করছেন। নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ ফেসবুকে চলে আসায় সাধারণ মানুষ আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সেবক ও চিকিৎসকরাই যদি বিপন্ন বোধ করেন, তবে আক্রান্তরা তো আরো অসহায় বোধ করবেনই।
গণমাধ্যমকর্মীরাও যাচাই-বাছাই না করে কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা, রোগী শনাক্তকরণ, শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, ব্যবস্থাপত্র প্রচার করছে। ওয়েব পোর্টালগুলোর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়। দেশি-বিদেশি অসমর্থিত অনেক তথ্য ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, যা সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। আক্রান্ত দেশগুলোতে কীভাবে মৃতদের দাফন করা হচ্ছে, তার বর্ণনা ও ছবি প্রকাশও দায়িত্বহীনতার মধ্যে পড়ে। একইভাবে ফেসবুক ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে কোভিড-১৯ থেকে নিরাপদ থাকার বিষয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের নানা দিক নিয়েও বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুজব ও বিভ্রান্তির সংক্রমিত হওয়ার গতি বাড়ছে।
যে সময়ে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তখন আমাদের এখানকার সময়কাল ঋতু বদলের। ধূলিময় শহর-গ্রাম। এই সময়ে এমনিতেই হাঁচি-কাশি থাকে। জ্বর, নিউমোনিয়াও দেখা দেয়। তাই কেউ কাশি দিলেই যেভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে, হাঁচি-কাশির প্রকোপ দেখেই বলে দেওয়া করোনা সংক্রমণের হার বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আশপাশে করোনা রোগী। চিকিৎসকদেরও কেউ কেউ সামনে আসতে চাইছে না। বাড়িমালিক নোটিশ করছে ভাড়াটেকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার। চাকরি ছাড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে। এসব কিছুই ঘটছে আতঙ্ক থেকে। আতঙ্কের পরিমাণ এতটাই যে অবহেলায় পড়ে গেছে সতর্কতা।
ইউরোপফেরত প্রবাসীসহ সব প্রবাসীকে যদি আমরা বিমানবন্দরে যথাযথ পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করতে পারতাম, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে যদি ইউরোপফেরতদের আটকে রাখা যেত, তাহলে পরিস্থিতি উদ্বেগ পর্যায়ে পৌঁছাত না। ইতালি থেকে যে পর্যায়ে প্রবাসীরা এসেছেন, দেশে তাদের কতটা আমরা হোম কোয়ারেন্টিন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছি? প্রশিক্ষণ দিলেও বাড়িতে তা অনুসরণ করার মতো তাদের সামাজিক বা পারিবারিক পরিবেশ ও সচেতনতা কি রয়েছে? নেই। নেই বলেই তাঁরা পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা করেছেন। আর এতে ছড়িয়ে পড়ছে কোভিড-১৯। সরকারের দিক থেকে চিৎকার করেও ধর্মীয়, রাজনৈতিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুলের সমাগমও বন্ধ রাখা যায়নি। স্কুল ছুটি, সরকারি ছুটি মানে বিনোদনকেন্দ্রে উপচে পড়ার যে অভ্যাস, এই আতঙ্কের মধ্যেও তা ছাড়তে পারিনি আমরা। সুতরাং কোভিড-১৯ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক ও গুজব ‘সহভাগ’ করে দেওয়ার যেমন দায়িত্বহীনতা কাজ করেছে, তেমনি নীতি নির্ধারকদের মধ্যেও দূরদর্শিতা ও সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। সেই ঘাটতির সুযোগ নিয়েছে কোভিড-১৯। তারপরও বলব, এখনো সময় কয়েক মূহূর্তের সময় আছে সামলে নেওয়ার। সমন্বিত ও জোরদার উদ্যোগ নিলে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে বাঁধ তোলা অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু সেই উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কি আমরা আলস্য ত্যাগ করতে পারলাম?
তবে সব উদ্যোগ সফল করতে সেবক ও চিকিৎসকদের সুরক্ষার দিকটি সবার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি