আমাদের বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনা
‘ফুটবল, ফুটবল, দুরন্ত ফুটবল / চারিদিকে ফুটবল নাম শুনি’ গান শুনে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম ছাড়াও যেকোনো বাঙালির কাছেই বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই উন্মাদনা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আর বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনার চিত্র অবশ্যই আলাদা কারণ। ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ থাকে, থাকে ক্রীড়ামোদী বাঙালির স্বপ্ন-আশাবাদেরও খেলা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ক্রিকেট বিস্তার লাভ করার কারণে ক্রিকেটপ্রেমীদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে এর ফলে বিশ্বকাপ ফুটবলের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। বাঙালির নিজস্ব খেলার তালিকায় ফুটবল খেলাটি না থাকলেও এ অঞ্চলে ফুটবলকে নিছক ছেলেখেলা হিসেবে দেখা মুশকিল। কারণ ধীরে ধীরে ক্রিকেটের মতোই বিদেশি এই খেলাটিও গভীরভাবে মিশে গেছে আমাদের জীবনযাপন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে। তাই ফুটবল নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস শুরু থেকেই। বাঙালি লেখকদের লেখাজোকায়ও নানাভাবে এসেছে ফুটবলের প্রসঙ্গ।
ফুটবল বিশ্বকাপ চার বছর পরপর পুরো এই ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে রীতিমতো এক উৎসবের উপলক্ষ্ এনে দেয়। দেশ, রাজনীতি, কূটনীতি, নির্বাচন- সবকিছু চুলোয় যাক, বাঙালি মেতে থাকে শুধুই ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনায়।
সারা বছর ফুটবল খেলা না দেখলেও বিশ্বকাপকে ঘিরে চার বছর পর শহরের-গ্রামের মানুষের মাঝে এক ধরনের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। নিজ নিজ বাড়ির ছাদে পতাকা টাঙিয়ে জানান দেওয়া হয় কে, কোন দলের সমর্থক। বিশ্বকাপ চলাকালীন ফুটবল ভক্তদের দেখা যায় প্রিয় দলের পতাকা তৈরি ও বাড়ি রং করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে ও ও ড়াতে পারে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাস্তা, বাড়ি ও মাঠে-ঘাট এখন বিভিন্ন দেশের পতাকায় ছেয়ে গেছে। জমি-বাড়ি বিক্রি করে গিনেস রেকর্ড করার মতো কয়েক মাইল লম্বা পতাকা বানাচ্ছে, সারা দেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানি-ফ্রান্সের পতাকায় ছেয়ে গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন দলের সাপোর্টাররা ফেসবুকে নতুন নুতন গ্রুপ খুলে তাদের দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়ে। শহরে সমবেতভাবে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখা ও খাবারের ব্যবস্থা করা ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে প্রীতি ম্যাচের আয়োজন দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে নিজ দলের শুভকামনা করে মিলাদ, এমনকি দল জিতলে গরু-খাসি জবাই করে উৎসব করতে দেখা যায়। সেই সাথে বিশ্বকাপের প্রচারে আগের মতো কলেবর না থাকলেও মিডিয়াগুলো বিশেষ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে, যেখানে সব দলকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো দলের সম্ভাবনা কতটুকু ছাড়াও খেলোয়াড়দের নিয়েও চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক খবরের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে বিশ্বকাপের খবর গুরুত্বের সাথে ছাপা হচ্ছে।
ফুটবল উন্মাদনার মধ্যে থাকা দেশের নাম হিসেবে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে সারা ফেলে থাকে। বিশ্বকাপ আসলেই এক মাসের জন্য এই দেশটির আকাশ-মাটি হয়ে যায় যেন এক টুকরো- ব্রাজিল, এক টুকরো আর্জেন্টিনা। সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপে ভাগ হয়ে যায় জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমারদের ছবি। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাতামাতির ব্যাপারটা পুরানো। এই মাতামাতির কেন্দ্রে থাকে ল্যাটিন অ্যামেরিকার দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ আসা মানেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই ভাগে বিভক্ত পুরো দেশ। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই বাসার খাওয়ার টেবিল, স্কুল-কলেজ, পাড়ার চায়ের দোকান, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্তদের তর্কবিতর্ক আর খুনসুটি লেগে থাকে সবখানেই। আজ এক দল নিজের বাসার ছাদে বিশাল আকারের ব্রাজিলের পতাকা টাঙিয়েছে তো, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে হায় হায় পড়ে যায় অবস্থা। ব্রাজিলের চেয়েও বড় পতাকা না টাঙালে পাড়ায় মানসম্মান বলে কিছু তো আর থাকছে না। কেউ কেউ তো আরেক কাঠি সরেস, বিশ্বকাপের সময় পুরো বিল্ডিংই ব্রাজিলের হলুদ-সবুজ অথবা আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা রঙে রাঙিয়ে ফেলেন।
এই প্রীতিময় উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য কেবলমাত্র ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরে নয়, আরো অনেক দেশের প্রতিও রয়েছে আমাদের অনেকের সক্রিয় প্রিয়তার প্রকাশ, উন্মাদনা। নিজের পছন্দের দলের জার্সি পরে ঘোরাফেরা, এমনকি প্রিয় দলের খেলার দিনে রোজা পর্যন্ত রাখা, বিশ্বকাপ নিয়ে বাঙালির সব পাগলামোর উদাহরণ আসলে বলে শেষ করা যাবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল এলে আগে সেলুন গুলোতে রীতিমতো লাইন পড়ে যেত। নিজের প্রিয় ফুটবলারের একটা পেপার কাটিং সংগ্রহ করেই দে ছুট সেলুনে। নিজের চুলের কাট হওয়া চাই একদম ঠিক পছন্দের ফুটবলারের মতই। একটা সময় বিশ্বকাপ চলাকালে দলবেঁধে সব মাথা ন্যাড়া করা তরুণদের ঘুরতে দেখা যেত। এদের কারও প্রিয় ফুটবল তারকার জন্য নিজেদের মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হতো না তারা। তবে এখনকার সময় বিশ্বকাপের উন্মাদনার অনেকটাই চলে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দাপটে। ফেসবুক খুললেই একে অন্যকে খুঁচিয়ে ট্রল আর স্ট্যাটাসের বন্যা বইছে রীতিমতো। যুগ বদলেছে, নিজেদের আবেগ প্রকাশের মাধ্যমটাও বদলেছে। তবে বিশ্বকাপ ঘিরে বাঙালির আবেগে ভাটা পড়েনি ছিটেফোঁটাও। এত এত উৎসবের মাঝেও কান পাতলে কোথায় জানি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। ইশ! বাংলাদেশও যদি বিশ্বকাপ খেলত। তবে নিজের দেশের অংশগ্রহণ ছাড়াই একটা পুরো দেশকে উৎসবে ভাসাতে পারে বলেই বোধ হয় ফুটবল খেলাটা এত বেশি সুন্দর।
বিশ্বকাপের মৌসুমে পাড়ায় পাড়ায় সম্প্রীতির বন্ধন চোখে পড়ার মতোন ঘটনা যেমন আছে তেমনি আছে অপ্রীতিকর নানাবিধ অপ্রিয় বিষয়ও। বাঙালি যেকোনো বিষয় নিয়েই বেশি মাতামাতি করে। এ কারণে বলা হয় হুজুগে মাতাল বাঙালি। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় প্রিয় দলের ভক্তদের মাতামাতি এতই বেশি যে মনে হয় যেন দলের জন্য প্রাণটাই দিয়ে দেয়। আর যদি আর্জেটিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকরা মুখোমুখি হয়ে যায় তা হলে কথাই প্রিয় বন্ধুরাও শত্রু হয়ে যায়। শুরু হয় তর্ক যুদ্ধ আর যদি মাতাল বা অন্ধ ভক্ত হয় তাহলে মারামারি পর্যায়ে চলে যায়। তবে আবেগের আতিশয্য কিংবা বাড়াবাড়ি নয় বরং কাতার বিশ্বকাপ নিখাঁদ আনন্দ আর উৎসবের উপলক্ষ নিয়ে আসুক প্রত্যেক বাঙালি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ,ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা।