এইডস প্রতিরোধে ভয় নয়, প্রয়োজন সচেতনতা
এইডস মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এ রোগ সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন করতে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় এইডস দিবস। ১৯৮৮ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক এইডস সোসাইটি এবং সে বছরই ১ ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর এদিন বিশ্ব এইডস দিবস পালন করা হয়।
যদিও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইচআইভি বা এইডস রোগ নির্মূলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র ৬৩ শতাংশ রোগী শনাক্ত করা গেছে। তবে, এসডিজির প্রথম শর্ত অনুসারে, এ সময়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার বাধ্যবাধকতা ছিল।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় কাজ করছে। জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র ২৩ টিতে এইচআইভি শনাক্তের সুবিধা রয়েছে। বাকি ৪১ জেলায় এখনো এই সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বিদেশ ফেরতদের এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না হওয়ায়ও অনেক রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল কর্মসূচির তথ্য বলছে, প্রতিবছর দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে এইচআইভি আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেখানে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ফেরত অভিবাসী ও কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার আগে সবার এইচআইভি পরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু কেউ দেশে ফেরত আসার পর এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ফেরত আসা কেউ এইচআইভি আক্রান্ত কিনা তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি নজরদারি পরিচালনা করেছে। এতে দেখা গেছে, যৌনকর্মী, শিরায় মাদক গ্রহণকারী, সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ১.৪ শতাংশ। এর মধ্যে শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া পুরুষ যৌনকর্মী/সমকামীদের মধ্যে এইআইভি সংক্রমণের হার বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ।
ইউএনএইডসের তথ্যানুযায়ী, ১৯৫৯ সালে প্রথম বেলজিয়ান কঙ্গোর কিনশাসায় মারা যাওয়া এক ব্যক্তির রক্তের নমুনায় এইচআইভি শনাক্ত হয়। এরপর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৩২ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। শনাক্তদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার আওতায় রয়েছেন।
এসডিজির শর্ত ৩.১ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতিসংঘ প্রদত্ত দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা হয়েছে, যা ৯৫-৯৫-৯৫ নামে পরিচিত। প্রথমে ২০৩০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত এসব রোগীর সবাইকে আনতে হবে চিকিৎসার আওতায়। তৃতীয়ত, যেহেতু এইচআইভির এখনো পরিপূর্ণ কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি, তাই ৯৫ শতাংশ চিকিৎসারত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসের মাত্রা রাখতে হবে নিয়ন্ত্রিত। সরকারের এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, প্রাথম ৯৫ শতাংশ রোগী শনাক্তের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাফল্য অর্জন হয়েছে মাত্র ৬৩ শতাংশ। দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাফল্য অর্জন হয়েছে ৭৬ শতাংশ। তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাফল্য ৯৩ শতাংশ।
জানা গেছে, ২০২১ সালে দ্য গ্লোবাল ফান্ডের আর্থিক সহায়তায় সরকার দেশের ৫টি হাসপাতালে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এইচআইভি সেবাকেন্দ্র চালু করেছে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পাবনা জেনারেল হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতাল, যশোর জেনারেল হাসপাতাল এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে এখন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এইচআইভি প্রতিরোধ সেবা, এআরটি, ওএসটিসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৪৫ জনের। এর মধ্যে ৪১ জন এইচআইভি পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই শিরায় মাদকগ্রহণকারী।
এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই কোনো লক্ষণ ছাড়া এ রোগ বহন করে। তবে কখনো কখনো এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পর কিছু কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন-জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, মুখের অভ্যন্তরে ঘা, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, স্বাস্থ্যের অবনতি, লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা ইত্যাদি। এসব লক্ষণ কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়, যে কারণে রোগী এই ভাইরাস সম্পর্কে বুঝতে পারে না। এইচআইভি কোনোরকম লক্ষণ ছাড়াই সর্বোচ্চ ১০ বছর মানুষের শরীরে বাস করতে পারে। বর্তমানে এইডস একটি ভয়াবহ রোগ হিসাবে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে আমেরিকায় এ রোগ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে রক্ত এইচআইভিমুক্ত কি না, তা স্ক্রিনিং করে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল রক্ত সরবরাহ করার পরামর্শ দেয়। একসময় এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য ছিল, তখন এ রোগকে ঘাতক রোগ বলা হতো। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মানবদেহে বিভিন্নভাবে এইডস রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা বীর্য বা জরায়ু রসের সঙ্গে যদি সুস্থ কোনো ব্যক্তির রক্ত, শরীর রস বা মিউকাশ আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তবে এইচআইভি তথা এইডস রোগের বিস্তার ঘটে। এসব সংস্পর্শ নানাভাবে ঘটতে পারে। যেমন-অবাধ যৌনাচার, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা দাঁতের চিকিৎসা বা অপারেশনসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার। এমনকি সংক্রমিত গর্ভবতী নারী থেকে শিশুর দেহেও এ রোগ ছড়াতে পারে। এইডস রোধকল্পে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিকারের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে এইচআইভির সংক্রমণ থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে। যেমন-অবাধ যৌনাচার বন্ধ করে নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, কনডমের ব্যবহার নিশ্চিত করা, রক্ত সংগ্রহের আগে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা, গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কি না তা পরীক্ষা করা, সুচ-সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা, প্রচারমাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করা।
এইডস থেকে নিজেকে, সমাজকে এবং মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। এজন্য ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা আমাদের আবাসভূমি নতুন প্রজন্মের জন্য সব ধরনের রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখব, এই হোক আগামী দিনের অঙ্গীকার।
লেখক : নিউজ প্রেজেন্টার, এনটিভি।