ভাবনায় বই ও বইমেলা
আমাদের প্রাণের মেলার নাম বইমেলা, যা বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা, একুশের বইমেলা নামেই পরিচিত। এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা; লেখকের মেলা, প্রকাশকের মেলা, পাঠকের মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ হয় শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ সৃজনশীল বই। শুধু বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক একটি মেলার আয়োজন, ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে লম্বা সময় ধরে ভাষাকেন্দ্রিক এই মেলা চলাটা অনেক বড় ব্যাপার, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২.
বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কে আছে? তাই যেখানে বই সেখানেই আমাদের প্রাণ কথা কয়। বইমেলা এ কারণেই আমাদের প্রাণের মিলনমেলা হয়ে ওঠে। একুশের বইমেলা হয়ে ওঠে বাঙালির বাঙালি হওয়ার অন্যতম সোপান। একজন শিক্ষক হিসেবে বই আর বইমেলা আমার কাছে গভীর তাৎপর্য বহন করে। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা বহন করে বই এবং বইমেলার এই অনন্য আয়োজন। শুভবোধ সৃষ্টিতে, চিন্তাচর্চায় প্রধান হাতিয়ার বই এবং বইমেলা হয়ে ওঠে কেবল আড্ডার, দেখাশোনারই নয়, ভাব-বিনিময়েরও বহুমাত্রিক সম্মেলনস্থল, ভাবনার ভরকেন্দ্র। অমর একুশকে কেন্দ্র করে যে বইমেলার উত্থান তাতে আমাদের ভাষা-কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বইমেলার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে জ্ঞানের উন্মেষ ও বিকাশের। আর সেই জ্ঞানের প্রবাহকে অবারিত রাখার প্রয়াসটাই হচ্ছে প্রজ্ঞার।
৩.
পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের বাঙালির ভাষা আন্দোলনই বোধ হয় এমনতর এক আন্দোলন, যার প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক। এর শুরুটা হয়েছিল বেদনাহত হৃদয় থেকে, শেষ হয়েছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের নিজস্ব ভূমির স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে। আর কোনো আন্দোলনের এত দীর্ঘপ্রসারী প্রভাব আছে বলে আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাঁদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। বাংলাদেশে লেখক-পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে একুশে গ্রন্থমেলার ভূমিকাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই মেলাকে ভর করে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বইমেলার কারণে অনেক নতুন, অনেক তরুণ লেখকের বই পড়ছি। আমাদের পাঠের সীমা বাড়ছে। ফলে অমর একুশে বইমেলা আপামর বাঙালির কাছে প্রাণজোয়ার সৃষ্টিকারী এক মেলায় পরিণত হয়েছে। বইপ্রেমী-দর্শনার্থী-ক্রেতা-বিক্রেতাদের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে বইমেলার আঙিনা। তখন বাতাসে কেবলই উড়ে বেড়ায় নতুন বইয়ের গন্ধ। এভাবে বইমেলার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। যদিও মুক্তচিন্তাচর্চার নানাবিধ বাধা এখনো বিদ্যমান দৃশ্যপটে।
৪.
আমাদের জাতীয় চেতনার এক বৃহত্তর আদর্শের নাম বইমেলা। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহক এ মেলায় জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ সর্বস্তরের মানুষের এক মহাসম্মিলন ঘটে এ মেলাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তথা বাঙালির মাসজুড়ে ধারাবাহিক এ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ও নৈকট্য পরিণত হয় পবিত্রতম উৎসবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশের মানুষকে এক মঞ্চে ঠাঁই দেয় অমর একুশে বইমেলা। আজ এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এক জাতীয় মেলা। এর রূপ, রং, চরিত্র আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার সমার্থক। কেননা বইমেলা প্রাঙ্গণে যাঁরা সমবেত হন তাঁরা শুধু বই কিনতেই আসেন না, আসেন সামাজিক দায় মেটানোর বোধ থেকেও। বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে। এখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা-পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক-প্রকাশক-পাঠক, দর্শকসহ বয়স-শ্রেণি নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়। সৃজনশীল প্রকাশকেরা হাজারও বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে সারা দেশের অগণিত গ্রন্থপিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাঙ্ক্ষাকে।
৫.
অতিমারি করোনাকালে বেড়েছে বইপ্রীতি। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকের ক্ষেত্রে পাঠ্যাভাস বেড়েছে। এই দুঃসময়ে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গভীর হলে, দৈনন্দিন জীবনে নিত্যসঙ্গী বই হলে আমাদের অনেক সংকট, অসুখ কমবে বলেই গভীরভাবে বিশ্বাস করি। যাপিত জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতায় বই হতে পারে অন্তরঙ্গ বন্ধু, বিশ্বস্ত সঙ্গী। কিশোর অপরাধ থেকে শুরু করে আত্মহত্যার মতো নানাবিধ আত্মঘাতী প্রবণতা প্রতিরোধে বইপাঠের অভ্যাস হয়ে উঠতে পারে সর্বোত্তম প্রতিষেধক। প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তুলতে পারি বই পড়ার ও পাঠচক্র পরিচালনার মুক্তচিন্তাচর্চার অভ্যাস। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রেরণার প্রধান উৎস হতে পারেন শিক্ষকেরা। শিক্ষক তাঁর পঠিত যে কোনও বই নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বই পাঠে উদ্দীপনা সৃষ্টিতে, প্রতিযোগিতার আয়োজন করে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে সবিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কেবল চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তরিক প্রয়াস, নিয়মিত চর্চা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়ায় ব্যাপৃত থাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠাগারটিকে করে তুলতে পারেন অন্যতম উৎস-কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে বই সংগ্রহ করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বইমেলায় গমন এবং পছন্দের বই কেনার বিষয়টির প্রতিও জোর দেওয়া যেতে পারে। পারস্পারিক অংশীদারত্বে পাঠাগারের জন্য বই ক্রয় এবং বইমেলায় পছন্দের বইয়ের তালিকা তৈরি হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যৎ সুনাগরিকের মননশীলতার বিকাশের অনন্য একটি প্রক্রিয়া।
৬.
একজন শিক্ষক হিসেবে জানি, শিক্ষার্থীর পরীক্ষার্থীর পরিচয়ের চেয়ে তাঁর মানবিক ও যুক্তিবাদী জীবন সাধনা প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে বই হয়ে ওঠে তার সৃজনীকর্মকাণ্ডের প্রধান প্রেরণার উৎস। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বই বিশেষ উপযোগী ভূমিকা পালন করে বলেও গবেষণায় জানা যায়। কারণ, বইয়ের পাতায় স্বপ্ন থাকে, থাকে জীবনে চলার পথের সুখ-দুঃখের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতার উপস্থাপনা। যা পাঠে নবীন শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি সমৃদ্ধ হয়, সবুজ মন নিজেকে স্বপ্ন ভেলায় বাসতে, আপন পথে চলার ক্ষেত্রে সকল বাধা দূর করে এগিয়ে যেতে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। আমি চাই বই পাঠের অভ্যাস হোক আমাদের জীবনের অংশ, ঘরের অলস সময় কাটুক বইয়ের পাতায় চোখ রেখে। তাই তো বিদগ্ধজনেরা বলেন : পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। তো, কেবল ভবিষ্যৎ জানা, জ্ঞানের আকর কিংবা সম্পদশালী হওয়ার জন্য নয়। নির্মল আনন্দ পাওয়া বা বিনোদিত হওয়ার এমন আশ্চর্য মাধ্যম আর কী-ই বা আছে? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যায়াম যেমন শরীর ভালো রাখার জন্য দরকার, তেমনি বই পড়াটা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অতি দরকারি। গবেষকেরা বই পড়ার গোটা বিশেক সুফল তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে কয়েকটা তো খুবই দরকারি। বই পড়ার সময় আমাদের চোখ আর মন যে কেবল কাজ করে, তা নয়; বরং কল্পনাশক্তিরও একটি চর্চা হয়। মস্তিষ্ক থাকে সচল। ফলে বই পড়া হয়ে পড়ে মানসিক উদ্দীপনার একটি নিয়ামক। গবেষণা বলছে, মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা বড় উপায় হচ্ছে বইয়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া। ঔপন্যাসিক আদ্রে জিদ যেমন বলতেন, বই দিয়ে নিজের একটা জগৎ গড়ে তুললে দরকারমতো সেখানে ডুব দেওয়া যায়। জ্ঞান কিংবা শব্দভান্ডারের বৃদ্ধি, নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানা, এসব সুফলের কথা তো আমরা সবাই জানি। তবে বই পড়লে সবচেয়ে বেশি বাড়ে বিশ্লেষণী শক্তি। বেড়ে যায় সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। বেড়ে যায় স্বপ্ন দেখার শক্তিও। সেইসাথে পড়ার অভ্যেসই পাঠককে লেখার শক্তিও দিয়ে থাকে। যত পড়া হয় তত লেখার দক্ষতা বাড়ে, নিজেকে মেলে ধরার ক্ষমতা বিকশিত হয়। বই পড়তে হয় মনোযোগ দিয়ে, কখনো কখনো কল্পনাকে ছেড়ে দিলে ফোকাস হওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা তৈরি হয় নিজের মধ্যে। জীবনকে ফুলের মতো বিকশিত করার জন্য চাই সঠিক দিকনির্দেশনা। বই শিশু-কিশোরদের জন্য ঠিক এ কাজটি করতে পারে। বইমেলা শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে আরও সহায়ক হবে, এটাই প্রত্যাশা। পূরণ হোক জাতি বিকাশের এই প্রত্যাশা। বইমেলা আমাদের অন্তরে যে বন্ধন তৈরি করে তা ভাঙে না কখনই। দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরণা জোগায়। সত্যিকার অর্থে বইয়ের ভাষা লেখক যেমন বুঝেশুনে হৃদয় দিয়ে লেখেন, সেভাবে পাঠককের বুঝেশুনে হৃদয় দিয়ে পড়তে হবে। বইমেলা পাঠকদের সেই শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটাতে পারবে, সব অন্ধকার দূর হবে বইয়ের স্পর্শে।
৭.
পাঠক হিসেবে আমার বিশ্বাস, কাগজে ছাপা বই হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দই আলাদা। যদিও যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় হাতের স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ কম্পিউটারেও ই-বুক বা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। যে মাধ্যমেই হোক বইপড়াকে জীবনের অংশ করে ফেলতে হবে। এ কারণেই গড়ে তুলবে হবে ঘরে ঘরে পাঠাগার। বইমেলা আমাদের সেই স্বপ্নকে সার্থক করতে রাখুক অগ্রণী ভূমিকা, সেই প্রত্যাশাই করি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা