সহমত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ম্লান একাত্তর
আচ্ছা বাবা বুদ্ধিজীবীরা কি ঘুমিয়ে আছেন? ভাবলাম কন্যা জানতে চাইছে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা। কারণ আমরা ওই মুহূর্তে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ পেরোচ্ছিলাম। গন্তব্য যেখানে, সেখানে অন্য পথ দিয়েও যাওয়া যেত। কিন্তু শনিবার এখানে আসা হবে না বলেই এই পথ বেছে নেওয়া। কন্যাকে বললাম, ওরা ঘুমিয়ে আছে। সেই একাত্তর থেকেই। কন্যা বলল—বাবা, আমি একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা বলছি না। এখন কি দেশে কোনো বুদ্ধিজীবী নেই? শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, চিকিৎসক, প্রকৌশলীরা কোথায়? একাত্তরে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁরা তো পেশাজীবীই ছিলেন। কাজ করেছেন—মুক্তিযুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কেউ পরোক্ষভাবে। শুধু কাজের জন্যই নয়, ওরা তো আমাদের মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। বাবা, এখন দেখছি সত্যি ওরা আমাদের মেধাশূন্য করতে পেরেছে।
প্রতিবাদ করি আমি—না মোটেও না। ওরা আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষক ও পেশাজীবীকে হত্যা করেছে ঠিকই। কিন্তু একাত্তর-পরবর্তী সময়ে মেধার দ্যুতি ঠিকই ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের পেশাজীবীরা দুনিয়াজোড়া সুনাম কুড়িয়েছেন। কন্যা বলে—সে তো ব্যক্তিগত সাফল্য, বাবা। আমরা সেই সাফল্যকে হয়তো নিজের মনে করে গর্বে বুক ফুলিয়েছি। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটুকু কাজ করেছেন? রাজনৈতিক সংকটগুলোর সময়, সমাজে নানা ইস্যুতে বিরোধ বা দ্বিধা তৈরি যখন হয়েছে, তখন তাঁদের অবস্থান কী ছিল? জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে যাওয়া। সুবচন দিয়ে হাততালি পাওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের তারকা-ইমেজ ধরে রাখার জন্য কাজ করেছেন। রাষ্ট্র এবং সরকারের জলবায়ু দেখে অবস্থান নিয়েছেন। যখন আবহাওয়া বুঝতে পারেননি, তখন নীরব থেকেছেন। আচ্ছা বলো বাবা—শিক্ষকরা, তোমরা সাংবাদিকেরা কি মানুষের জন্য কাজ করছ; না কি নিজেদের টিকে থাকার কৌশল নিয়ে আছ? কন্যাকে বললাম, দেখো একাত্তর আর ২০১৯-এর প্রেক্ষাপট আলাদা। কন্যার কণ্ঠে ক্ষোভ, এটা তোমাদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত।
আমরা গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি। দূর থেকে শর্ষে খেত দেখা যাচ্ছে। কন্যার নামার ইচ্ছে। শর্ষে ক্ষেতে ছবি তোলা উদ্দেশ্য নয়। শর্ষের ঘ্রাণ নেবে।
নামার আগে কন্যা দ্রুত বলে যাচ্ছে—দেখো বাবা আমি একাত্তর দেখিনি। তুমি নব্বইয়ের স্বৈরাচার আন্দোলন দেখেছ। আমি তো তার এক দশক পরে এলাম। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ, নো ভ্যাট আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন তো দেখা হলো। ভেবেছ ছোট মানুষ। আমরা কী বুঝব। আমাদের কাছে ঝকঝকে পরিষ্কার তোমাদের মুখ। দেখেছি ওইসব আন্দোলনে বালিতে কেমন মুখ গুঁজে ছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। হাওয়া বুঝে মুখ বের করেছেন, আবার গর্তে ঢুকে পড়েছেন। বাবা যত অল্পই পড়ালেখা করি না কেন আমরা বা গান-ছবি দেখি, বলতে পারো একাত্তরের পরে বাংলাদেশে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক বা সিনেমা কয়টি তৈরি হয়েছে? জানি খুঁজে বের করতে পারবে না। কতগুলো নাম হয়তো তোমরা বলবে, সেগুলো নিজেদের ঢোল পেটানো কাজ। সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। কেন জনমানুষ বা সমাজ নিয়ে সাহিত্য, গান, সিনেমা তৈরি হচ্ছে না, জানো? আমি আগের মতোই চুপ থেকে ইশারায় জানতে চাই, কেন? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁরা এখন সহমতের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন। ভুল বললাম, আসলে তাঁরা কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে নেই। আর একাত্তর বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেও অনেকটা দূরে সরে গেছেন। যত স্লোগান দেখ একাত্তর নিয়ে, সে কেবল ব্যক্তিবাণিজ্যের উদ্দেশ্যে।
আমার কিছু বলার দুঃসাহস নেই। তাই চুপচাপ হলুদ শর্ষে ক্ষেতে নেমে পড়ি।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি