৮০ ভাগ বাস ভাড়া, শতভাগ ঝুঁকি
ছুটি শেষে আমমানুষের জন্য যে এমন টিফিন অপেক্ষা করছিল, তা আগে থেকে আঁচ করা যায়নি। ২৬ মার্চ থেকে কাটিয়ে আসা দিনগুলো মানুষের ফুর্তিতে কেটেছে এমন বলা যাবে না। যদিও ছুটির মাঝে বর্ষবরণ ও ঈদ ছিল। পুরো সময়ই কেটেছে আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে। নিজে ও পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ল কি না, নিজের পরিবারে করোনা প্রবেশ না করলেও সহকর্মী, প্রতিবেশী এবং স্বজনদের অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ চলেও গেছেন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে। এমনকি গণমাধ্যমে আসা দেশ-বিদেশের কোভিড সংক্রমণ, মৃত্যুর পরিসংখ্যান এবং পরিচিত নাম ও মুখের মৃত্যুর খবরও মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। সেইসঙ্গে ছিল চাকরি হারানোর ভয়, বেতন বকেয়া হয়ে যাওয়া। ছুটিকালে খরচ সামলানোর লড়াইও ছিল।
ছুটির মাঝে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার খবরে গ্রামগঞ্জ থেকে সাধারণ মানুষের শহরে ছুটে আসা। তারপর আবার ফিরে যাওয়া এবং সর্বশেষ ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার খবরে মানুষের শহরমুখী ঢল দেখে আঁতকে উঠছেন যেমন অনেকে, তেমনি বিদ্রুপও করছেন। কেন মানুষ ছুটে আসছে এভাবে? সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারী থেকে শুরু করে অনেক বড়কর্তাও ঢাকার দিকে ছুটে এসেছেন উদ্বেগ ও ঝুঁকি নিয়ে। কাজটা, চাকরিটা থাকবে তো? কাজে ফিরে কাউকে কাউকে দুঃসংবাদ শুনতে হয়েছে। কাজ নেই। ছাঁটাই। কাজ থাকলেও বকেয়া বেতন আর দেওয়া হবে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বেতনের সঙ্গে থাকা নানা ভাতা কর্তন করে বসে আছে। বেসরকারি চাকরিজীবী অনেকেরই আগের আয় থাকছে না। কমে যাবে। যাঁরা নিজস্ব ব্যবসা বা প্রতিদিনের রোজগারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁদের আয়ের উৎস সচল করতে সময় লাগবে। খুব শিগগির আয়ের পুরোনো পথ খুলে যাবে না। অনেককে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয় কিন্তু কমেনি। বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। বাজেটের পর বাড়িয়ে দেয় কি না, সেই আতঙ্ক কাজ করছে। সন্তানের স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও বেতন গুনে যেতে হচ্ছে ঠিকই। এ অবস্থায় কাজে যাওয়ার জন্য তার যে বাহন, যাকে গণপরিবহন বলা হয়, সেই পরিবহনের ভাড়া জ্যামিতিক হারকেও টপকে গেল।
গণপরিবহনের ভাড়া কখনোই এক লাফে দশ ভাগের বেশি বাড়েনি। এবার রেকর্ড আশি ভাগ বাড়ল। যুক্তি দেখানো হয়েছে, বহনক্ষমতা বা সিটের অর্ধেক যাত্রী নেওয়া হবে বাসে, যার মাশুল যাত্রীকেই দিতে হবে। কোভিড-১৯ শুধু বাংলাদেশেই ছোবল দেয়নি। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ আক্রান্ত হয়েছে। কোথাও গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর নজির নেই; বরং করোনাকালে ফ্রি করে দেওয়ার নজিরই বেশি। বাংলাদেশও সেই নজির স্থাপন করতে পারত, যদি সরকারি গণপরিবহন বিআরটিসিকে তারা পথে রাখতে পারত। পারেনি। বেসরকারি বাস মালিকদের চাপে বিআরটিসি উঠে গেছে পথ থেকে। বিআরটিসি এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বহন করে। সরকার শতভাগ বেসরকারি পরিবহন মালিকদের ওপর জিম্মি। রাজধানীতে বাস রুট তৈরি, চার, পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে বাস রুট পরিচালনার কাজ ও পরিকল্পনা গত দু-তিন বছরে শুরু করতে পারেনি। করোনার শুরু থেকে বাস শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কোনো মালিক সংগঠনকে। যদিও চাঁদা আদায়ের বড় অঙ্ক রয়েছে তাদের পকেটে। কিন্তু যখন গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত এলো, তখন ঠিকই সরকারকে চাপের মুখে ফেলে, গণমানুষকে আরো বিপর্যস্ত করতে ঠিকই তারা ভাড়া ৮০ ভাগ বাড়িয়ে নিল। সোমবার থেকে বাস পুরোদমে চালু হওয়ার কথা। বাস মালিকরা অর্ধেক যাত্রী দিয়ে বাস চালানোর যে অঙ্গীকার করেছে, প্রথম দিনই সেই অঙ্গীকার ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮০ ভাগ নয়, শতভাগ। ফলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকির পাশাপাশি থাকছে বিশৃঙ্খলারও অশনিসংকেত।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি