নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (নাসিক) সরকার-সমর্থিত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও বর্তমান সময়টি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনার মৌসুম চলায় নির্বাচনটি ছিল ভিন্নমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও গণমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের মন্তব্য পর্যালোচনায় নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, সরকারি দলের প্রভাব থাকবে কি না এসব প্রশ্নে এক মাস ধরে পুরো গণমাধ্যম ছিল সোচ্চার। শুধু গণমাধ্যমে নয়, দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের দৃষ্টি ছিল নাসিক নির্বাচনের দিকে।
সারা দেশে নির্বাচনী উৎসবমুখী আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন রাজনীতির মাঠে একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। স্থানীয় নির্বাচন হলেও এটি মূলত জাতীয় রাজনীতিকেই মঞ্চস্থ করেছে, তা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নাসিক নির্বাচন-পরবর্তী মন্তব্য করেছেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’ এ ছাড়া অন্য যে কথাগুলো তিনি বলেছেন, সেগুলো নিতান্তই রাজনৈতিক। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের বাহ্যিক পরিবেশকে ভালো বলে আখ্যায়িত করার ইতিবাচক সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃষ্টান্ত বলে অখ্যায়িত করতে পারি।
নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নাসিক নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা। বিশেষ করে সরকারের অধীনে সরকারি-প্রভাবমুক্ত শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে বিএনপি প্রার্থী যে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনেছেন, সেটিও পরাজিত প্রার্থীর রাজনৈতিক বক্তব্য। এ বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে চার বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন ও ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার-সমর্থিতদের ভরাডুবি এবং বিরোধীদল সমর্থিতদের জয়জয়কার হয়। স্থানীয় নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচনটি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ব কাছাকাছি দূরত্ব সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় নির্বাচনী ফলে ভিন্নমাত্রা লক্ষণীয় ছিল। বিশেষ করে ২০০৮ সালে চার সিটির নির্বাচনে (রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল) মহাজোট-সমর্থিতদের বিজয়ের কয়েক মাস পরেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মহাবিজয় ঘটায় ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। এ বিবেচনায়ও ২০১৩ সালের পাঁচ সিটির নির্বাচনও তৎকালীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক ফল নির্ধারণে প্রভাব সৃষ্টি করত, তা নিয়ে আশঙ্কা করাই যায়। কারণ, তৎকালীন সময়ে স্থানীয় নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে তালা, আনারস, দোয়াত-কলম এবং টেলিভিশন মার্কায় নির্বাচন হলেও মূলত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ভোট হয়েছে। তার পরও তৎকালীন সময়ের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধীদলীয় নেতা সংসদে বাজেট বক্তৃতায় সরকারকে উদ্দেশ করে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে হাস্যকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। ফলে এবারের নাসিক নির্বাচন-পরবর্তী কেউ কারচুপির অভিযোগ আনলে সেটি হবে নিতান্তই হাস্যকর।
বিগত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে নির্বাচন চলাকালীন বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা ও বড় রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির বিষয়টি গণমাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তবে বর্তমানে বিএনপির রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাসিক নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যভাবে টিকে থাকার বিষয়টিও যথেষ্ট ইতিবাচক। কারণ, এ নির্বাচন থেকেও বিএনপি সরে গেলে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠত। কাজেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে হলে সব রাজনৈতিক দলের সমান ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গ্রহণের মানসিকতা ব্যক্ত করলেই হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে আন্তরিকভাবে নির্বাচনে টিকে থাকতে হবে।
নির্বাচনী সংস্কৃতিকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে শুধু সরকার কিংবা প্রশাসনের প্রভাবমূক্ত নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিকতাই জরুরি। সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে বা বৈধ উপায়ে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয় না। নাসিক নির্বাচনের ফলে সর্বসাধারণের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হলো যে, সরকারের জনপ্রিয়তার মাত্রার মাপকাঠি অনেকটা সন্তোষজনক। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে উপলব্ধি করতে হবে যে সরকারের জনপ্রিয়তাই শুধু নয়, বিএনপির অবস্থানগত দুর্বলতাও আওয়ামী লীগকে বিভিন্নভাবে ক্রমেই এগিয়ে দিচ্ছে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, বিএনপি এখন ইতিবাচক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বিএনপিরও এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি অন্যতম লক্ষ্য। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি বিএনপির চেয়ারপারসন নিজে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন কমিশন গঠনে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। বিএনপি পূর্বের ভুলগুলো শুধরে হলেও তারা যে এগিয়ে রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে চায়, তা নাসিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
বর্তমানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনী ধারায় দেশবাসী গণতান্ত্রিক ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে।
ক্ষমতায় কে অধিষ্ঠিত হবে আর না হবে, তা নির্ধারণ করার মালিক জনগণ। বর্তমান সময়ে মিডিয়ার স্বচ্ছ তৎপরতার প্রভাবে ও জনসচেতনতার কারণে কোনোভাবেই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে কিংবা ভোট কারচুপি করে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব না। কাজেই কোনো অজুহাতেই নির্বাচন বর্জন এবং দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগে পা না রেখে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা ন্যায়সংগত। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় বড় দলকেই লক্ষ রাখতে হবে যে, দেশে উদ্ভূত সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের যেন সৃষ্টি না হয়।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।