নির্বাচন কমিশন
লক্ষ্য হোক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা
নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি নবগঠিত কমিশনের শপথ গ্রহণ। এই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের দিকেও জনসাধারণের একটি বিশেষ নজর রয়েছে। কারণ, এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে। সবার মনে এখন একটিই প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন করতে পারবে কি না? তার আগে থেকেই যে প্রশ্নটি রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রয়েছে সেটি হলো, নির্বাচন কমিশনে কাদের পাল্লা ভারী হলো। অতীত রেকর্ড কার কেমন? এমন সব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ব্যক্ত করছে। বিএনপি কিছুটা আপত্তি দেখালেও আওয়ামী লীগ নবগঠিত কমিশনে আন্তরিক সাধুবাদ জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কার্যত শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের মধ্য দিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন এবং অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাব করা ১০টি নাম থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনই নবগঠিত কমিশনের মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। আর এর মাধ্যম হলো তাদের কার্যক্রম। মূলত নিজেদের কাজ দিয়েই সেটা প্রমাণ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন কেমন হলো—এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। কারণ, একই কায়দায় ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পূর্ববর্তী কমিশনও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে যে সুবাতাসের ধারা বইতে শুরু করেছিল, তার সামগ্রিক ফলাফল ভালো হয়নি। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ড সোজা রেখে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধান কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার যথাযথ অনুশীলন আবশ্যক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এক দল যদি কাউকে ‘হ্যাঁ’ বলে আরেক দল তাঁকে ‘না’ বলবেই। এবার মূলত আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২৭টি দল নামের তালিকা দিয়েছিল। আর এই তালিকা থেকে সার্চ কমিটি ১০ জন, তারপর রাষ্ট্রপতি পাঁচজনের নাম ঘোষণা করেছেন, যা অতটা সহজ ব্যাপার ছিল না। এই স্বল্পতম সময়ে দল-মত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য মানের কমিশন নিয়োগ করা কঠিন বিষয়। তবুও বিষয়টি স্বল্পতম সময়ে সম্ভব হয়েছে, এ জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। আমাদের দেশে যেকোনো বিষয় নিয়েই অনৈক্যের প্রসঙ্গ থেকেই যায়। দেশের কল্যাণে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ঐকমত্যের সংস্কৃতির চর্চার অপেক্ষায় দেশবাসী অনেক দিন থেকেই আছে। তবে সবচেয়ে আশার কথা হলো, কোনো ধরনের জোরালো আপত্তি ছাড়াই এই কমিশন গঠিত হয়েছে।
২০১৯ সালে একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে দেশের আপামর জনসাধারণ। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে সৎ, দক্ষ ও নিরপেক্ষ হয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কোনো বিকল্প নেই। তবে বিভিন্ন কারণেই একটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রশাসন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মূল ক্রীড়নক নয়। এর জন্য মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই মুখ্য। তবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম নিদর্শন। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনকে ঢালাওভাবে অভিযোগ দেওয়া যায় না। সে জন্যও আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে দায়ী করতে পারি। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে হলে সরকারি দল ও সরকারবিরোধী দলগুলোকে সমান ভূমিকা রাখতে হয়। শুধু সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গ্রহণের মানসিকতা ব্যক্ত করলেই হয় না। এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে আন্তরিকভাবে নির্বাচনে টিকে থাকতে হয়। সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে বা বৈধ উপায়ে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয় না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও অবস্থানও এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও মতৈক্য ছাড়া গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। এ ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারি দলের দায়িত্ব অনেক বেশি থাকে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগ যেভাবে মেনে নিয়েছে, তেমনি বিএনপিকেও স্থায়ীভাবে তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা ব্যক্ত করা যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। বিএনপি গঠনমূলক মতামতের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যেকোনো দলই রাজনৈতিক গেম খেলার চেষ্টা থাকলে রাজনীতির জন্য তা হবে চরম ভুল। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রশ্নে বেশি উচ্চবাচ্যের ইস্যু দেখা দিলে সাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে এক ধরনের অনীহা ও অনাস্থা তৈরি হবে। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা এবং নির্বাচন-পদ্ধতির ওপর নাগরিকদের স্থায়ী আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাই এখন সবার প্রত্যাশা। বিশেষ করে নির্বাচনী সংস্কৃতিকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে শুধু নির্বাচন কমিশন, সরকার কিংবা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আস্থানির্ভর ক্ষেত্র তৈরিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।