‘ডুব’ বিতর্ক
নেতিবাচক খবরই বড় বিজ্ঞাপন
বলা হয়, বিজ্ঞাপন এমন জিনিস, জাহান্নামের বিজ্ঞাপন দেখার পরও আপনার মনে হবে, আহা এখনই যদি জাহান্নামে যাওয়া যেত!
তবে পজিটিভি বিজ্ঞাপনের চেয়ে নেগেটিভ বিজ্ঞাপন বা ব্র্যান্ডিংয়ের শক্তি বেশি। কোনো বই নিয়ে অতিমাত্রায় সমালোচনা হলে বা নিষিদ্ধ হলে সেটি কেনার জন্য পাঠকের যে কী দুর্নিবার আগ্রহ তৈরি হয়, সেই অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই আছে। সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণেই তুমুল আলোচনায় আসে এবং বইটি কেনার জন্য আমি সুদূর ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসি। বইয়ের বড় বড় দোকানে না পেয়ে নীলক্ষেতের ভেতরে একটা দোকান থেকে বইটার একটা ফটোকপি ভার্সন পাই এবং সেটা বেশ চড়া দাম দিয়ে কিনি। বইটা নিষিদ্ধ না হলে আমার হয়তো কখনো পড়াই হতো না।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে এখন গণমাধ্যমে যা হচ্ছে, তা এই সিনেমার বিজ্ঞাপন বা ব্র্যান্ডিংয়েরই অংশ বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমি যে লিখছি, আদতে এটিও এই সিনেমার একধরনের স্বয়ংক্রিয় বিজ্ঞাপন হয়ে যাচ্ছে।
কোনো একটি পণ্যের গুণাগুণ শুনে বা টেলিভিশনে দেখে ভোক্তার মনে সেটি কেনার আগ্রহ তৈরি নাও হতে পারে। কিন্তু একই পণ্যের একটু অফট্র্যাকে বা উল্টোপাল্টা প্রচার করলেই সেটার কাটতি যে বাড়ে, তার বড় উদাহরণ প্রতিবেশী ভারতের টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন। বিষয়ের ধারেকাছে না গিয়ে উদ্ভট সব জিনিস দিয়ে পণ্যের বিজ্ঞাপন নির্মিত হচ্ছে এবং সেই ধারা এখন আমাদের দেশেও চালু হয়েছে। ফলে সহজেই এটা দর্শককে আকৃষ্ট করছে। শিল্পে অ্যাবসার্ডিটির একটা আলাদা আবেদন সব সময়ই ছিল এবং আছেও, যা এখন টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে অতিমাত্রায় দৃশ্যমান। কখনো পণ্যের নামে চমক দিয়েও ভোক্তার কাছে সেটি গ্রহণযোগ্য করে তোলার একটা চেষ্টা থাকে, যার একটা বড় উদাহরণ পচা সাবান। একসময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এর বিজ্ঞাপন।
‘ডুব’ প্রসঙ্গে আসা যাক। এই নামে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যে একটা সিনেমা বানাবেন, তা গণমাধ্যমে চোখ রাখা পাঠক-দর্শক বহু আগে থেকেই জানেন। সিনেমার গল্পটা যে বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কোনো একটা অধ্যায় বা এই সিনেমার নায়ক যে বস্তুত হুমায়ূন আহমেদই, তা আর গোপন থাকেনি; বরং ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে চাওয়াটাও এক ধরনের বিজ্ঞাপনী কৌশল। যেমন লোকজন এরই মধ্যে বলাবলি শুরু করে দিয়েছে, ‘ডুব’ দেখতে হবে। অর্থাৎ এ নিয়ে যত বেশি জল ঘোলা হবে, এর প্রতি দর্শকের আগ্রহ তত বাড়বে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা যাচ্ছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন একটি চিঠি দেন সেন্সর বোর্ডে, যেখানে তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন, যাতে এই সিনেমার কাহিনী নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়। সেইসঙ্গে এই সিনেমায় আপত্তিকর কোনো বিষয় থাকলে সেগুলো যেন যথাযথভাবে পরিবর্তন এবং পরিশোধন করে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে ‘ডুব’ সংশ্লিষ্টদের সিনেমাটির অনাপত্তিপত্র স্থগিত করার বিষয়ে জানায় সেন্সর বোর্ড।
এ বিষয়ে এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন শাওন, যেখানে তিনি বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ‘ডুব’ নির্মিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের জীবনের অনেক গল্পই পাঠক-দর্শকের জানা। সেই সত্য গল্পের সঙ্গে কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং তাঁকে নিয়ে ট্যাবলয়েড পত্রিকার কিছু চটকদার গুজবজুড়ে দিয়ে সিনেমা বানানো নৈতিক নয়।’ যদিও ফারুকীর দাবি, তাঁর ছবির সব চরিত্র কাল্পনিক। তিনি ‘ডুব’ সিনেমাটি আটকে দেওয়ার ঘটনাকে বাকস্বাধীনতা ওপর হস্তক্ষেপ বলেও বর্ণনা করেছেন।
বিজ্ঞাপন ও গণমাধ্যমের রাজনীতি যাঁরা বোঝেন-জানেন এবং খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন এই জগতের ভেতরে-বাইরে কী হয়। কোন পণ্যকে কীভাবে বিজ্ঞাপিত করলে পাবলিক ‘খাবে’, সেটি তাঁরা ভালো করেই জানেন। সুতরাং আমরা ধরেই নিতে পারি যে শেষ অবধি ‘ডুব’ সিনেমাটির ছাড়পত্র ঠিকই দেবে সেন্সর বোর্ড। মাঝখানে গণমাধ্যম ও ফেসবুকে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তর্ক-বিতর্ক এবং চায়ের টেবিলে ঝড় উঠবে। বোদ্ধাগণ এখানে বাকস্বাধীনতা খুঁজবেন। কিন্তু আখেরে পুরো বিষয়টিই বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনের যে কী ক্ষমতা, তার একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। সম্প্রতি ‘বহুল আলোচিত’ (অতি বিজ্ঞাপিত) একটি সিনেমা দেখে ফেরার পর আমার একাধিক ঘনিষ্ঠজন বলেছেন, ‘ফাউল সিনেমা।’ কেউ কেউ একটু বিনয় প্রকাশের জন্য বলেছেন, ‘সিনেমাটা বুঝতে পারি নাই। বোধ হয় আমাদের জন্য বানানো হয়নি।’ তো, কোনো সিনেমার গল্প যদি বিমূর্ত চিত্রকলার মতো দর্শকের মাথার ওপর দিয়ে যায় এবং সিনেমা হল থেকে ফেরার পরে দর্শক যদি সেটা নিয়ে খিস্তি করে, তাহলে তার দায় ওই বিজ্ঞাপনেরই। এখানে সার্থক মার্কেটিং। দর্শকের মন ও মেজাজ পড়তে পারে যে বিজ্ঞাপন—পয়সা তো সেই কামাবে।
লেখক : সাংবাদিক