বাজেট পর্যালোচনা
উচ্চশিক্ষার মূল্য আর কত বাড়বে?
এ বছরের বাজেটে বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ওপর ১০% মূল্যসংযোজন কর বসানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই ‘মূল্যসংযোজন কর’ কেন আমি জানি না। কারণ আমি বাজেটের এত হিসাব-কিতাব বুঝি না। আমি যা বুঝি তা হলো এই ১০% কর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা শুরু করবে। বাংলাদেশের বহু মানুষের যেমন ধারণা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় লোকের ছেলেমেয়ে পড়ে, তেমন ধারণা মনে হয় সরকারের মধ্যেও রয়ে গেছে।
আমি নিজেও পড়াশোনা করেছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মোটেও কোনো বড় লোকের ছেলে নই। আমার বাবা তখন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। আমাকে ২০০৫ সালে ভর্তি করানো হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০০৬ সালে উনি অবসরে চলে যান। অর্থাৎ তাঁর জীবনের জমানো অর্থ দিয়েই আমাকে পড়িয়েছেন। যখন আমি ভর্তি হই, তখন প্রতি ক্রেডিট ছিল ৩৩০০ টাকা। যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র ভর্তি হয়, তখন মধ্যবিত্ত পরিবারের সবাই আগে হিসাব করে নেয় আনুমানিক কত টাকা তার খরচ হতে পারে। সুতরাং আমিও হিসাব করেছিলাম। তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মোট ক্রেডিট ছিল ১৩৮টি। অর্থাৎ এই ক্রেডিটের খরচ পড়বে চার লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ টাকা। আর আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে তা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা হতে পারে।
কিন্তু ২০০৭ সালে হুট করেই আমাদের ক্রেডিট ফি বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ৩৩০০ টাকা থেকে তা ৪০০০ টাকা করা হলো। আমরা তখন ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ জানালাম। বড় বড় পোস্টার লিখলাম। শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর গ্রহণ শুরু করলাম। আমরা সবাই তখন একটাই অনুরোধ করেছিলাম, এই ক্রেডিট ফি যেন পুরোনো শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো না হয়। কারণ এতে আমাদের মা-বাবার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যাবে।
শিক্ষার্থীদের দাবি প্রশাসন বুঝতে চাইল না। আমার এখনো মনে আছে- আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কয়েকজন বড় ভাই তৎকালীন উপ-উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। কীভাবে যেন মিডিয়ায় খবরটা ছড়িয়ে গেল। ইটিভির একটা গাড়ি এসে থামল ভিসি অফিসের সামনে। সাংবাদিক দেখে আমরা তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না আসলে আমাদের কী করা উচিত, কারণ তখন আমরা একদমই ছোট। এর মধ্যেই একজন বড় ভাই ভিসি অফিস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি আমাদের একপাশে নিয়ে বললেন, ‘সাংবাদিক ডেকেছে কে?’ আমরা বললাম, জানি না।
তখন তিনি বললেন, ‘এই বিষয়ে কেউ সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলবে না। আমরা প্রশাসনের সঙ্গে নেগোশিয়েট করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলে আমাদের নিজেদের ইউনিভার্সিটির ইমেজে সমস্যা হবে। আর একাডেমিক প্রেসারও আসতে পারে।’ আমরা তখন সবাই নীরব হয়ে গেলাম। সাংবাদিক কিছুক্ষণ ছিলেন। কথা বলার চেষ্টা করলেন। রেসপন্স না পেয়ে হতাশ হয়ে চলেও গেলেন।
কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। ৪০০০ টাকা ক্রেডিট ফি রয়েই গেল। আমাদের ওপর ওই ফি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কিছু করার ছিল না তখন। কিন্তু লাভের লাভ হয়েছিল। ওইবার হয়তো ছাত্রদের তোপের মুখে পড়তে পারে এই বিষয়ে প্রশাসনের ধারণা ছিল না। এ জন্য পরবর্তীকালে যতবারই ফি বেড়েছে, শুনেছি পুরোনো শিক্ষার্থীদের এই বেড়ে যাওয়া ফি দিতে হয়নি। তবে যতটুকু শুনেছি ২০১১ কি ২০১২ সালে এভাবেই আবার টিউশন ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আমরা আন্দোলনে জয়ী হইনি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই নিজেদের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই অনেক প্রতিবাদের খবর গণমাধ্যমে আসে না। কারণ শিক্ষার্থীরা চায় না তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নেগেটিভ খবর প্রকাশ পাক। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সবাই নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সালে। ওই বছরও সরকার ৪% ভ্যাট আরোপ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলা হয় মুরগির খোয়াড়ের ছাত্র। তারা প্রতিবাদ করতে জানে না, বিক্ষোভ করতে পারে না। এই সমস্ত ধারণাকে পেছনে ফেলে ২০১০ সালে ঢাকার বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। তারা শিক্ষার জন্য আন্দোলনে নামে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি তাদের বিক্ষোভের ওপর পুলিশি নির্যাতন চলে। তারা তো সন্ত্রাসী ছিল না, তারা তো কোনো অন্যায় করেনি তবুও তাদের ওপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়, লাঠিপেটা চালায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবুও তাদের রুখে রাখতে পারেনি। তাদের উত্তাল বিক্ষোভের মুখে সরকার ওই ৪% ভ্যাট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
সরকারের নিশ্চয়ই বোঝা উচিত, এসব ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে পড়াশোনার খরচ বেড়ে গিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর চাপ পড়ে। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়ে তাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা-মা পড়তে পাঠায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। নিজের জীবনের জমানো পাই-পাই অর্থ একসঙ্গে করে পড়তে পাঠায়। অনেক শিল্পপতির কাছে ছয়-সাত লাখ টাকা কোনো ব্যাপার না। তারা হয়তো কোথাও ঘুরতে গেলেই এত টাকা খরচ করে আসে। কিন্তু আমাদের বাবা-মা হয়তো এই ছয়-সাত লাখ টাকা জমিয়েছেন ২০ বছরে। নিজের অনেক ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে ২০ বছরের সঞ্চয় আমাদের দিয়ে দিচ্ছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। আমরা শিক্ষিত হলে বাবা-মায়ের লাভ কী? সত্যিকার অর্থে কোনো ব্যক্তিগত লাভ তো নেই। কিন্তু দেশের লাভ আছে। দেশের জন্য এই উচ্চশিক্ষিত তরুণ প্রজন্মই নিজেদের সবটুকু বিলিয়ে দেবে। তাদের হাতেই গড়ে উঠবে অনেক কিছু।
বর্তমান সময়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন, অধিকাংশ উদ্যোক্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা। দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাও হয়ে উঠেছেন তাঁরা। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকছেন, পুলিশে ঢুকছেন। শুধু তাই নয় আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমন ৫০ জন শিক্ষার্থীর নাম আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারব যাঁরা এখান থেকে অনার্স শেষ করে এখন বিদেশে কেউ মাস্টার্স করছেন, কেউ সেখানে মাস্টার্স শেষ করে এখন পিএইচডিও করেছেন কিংবা করছেন। এমন আরো অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন বিদেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। তার মানে এখন আর সেই দিন নেই, যেই দিনে বলা হতো, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লোকের বখাটে ছেলেমেয়েরা পড়ে। কিংবা টাকার জোরে পড়ে।
একবার শুধু ভেবে দেখা যাক, যদি এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকত তাহলে এত শিক্ষার্থীদের জীবন কেমন হতো? অবলীলায় বলে দেওয়া যায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশের জীবনই অন্যরকম হতো।
২.
এখন এই কর বৃদ্ধির প্রস্তাবনাটি যখন এলো, তখন নিশ্চয় সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। অনেকেই এক অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন। এই বুঝি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি বাড়িয়ে দেয়। সরকারের ভাবা উচিত যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে চলছে তখন এই ভ্যাট বৃদ্ধি তাদের গতিকে শ্লথ করে দেবে।
গত বছর ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে সোশ্যাল সায়েন্সের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। আমি নিজেও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘শুধু নেতিবাচকভাবে খারাপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয় ফলাও করে প্রচার না করে ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিবাচক দিকগুলোও প্রচার করা উচিত।’ তার মানে তিনিও চান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোমতো তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাক। তাহলে যদি সৎ উদ্দেশ্য থাকে তবে কেন ভ্যাট বৃদ্ধি করে তাদের গতিকে বাধাগ্রস্ত করা?
আমি শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলতে চাই, এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একান্ত নিজেদের প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলছে। সরকার তাদের কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা করে না। তবু তারা এগিয়ে চলেছে। আপনারা দয়া করে এই প্রস্তাবিত ভ্যাটকে প্রত্যাহার করুন। বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য টিউশন ফি কীভাবে কমানো যায় সে চেষ্টা করার দিকে মনোনিবেশ করুন।
৩.
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক হাজার ২৩৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই তথ্য নিশ্চয় সরকারের কাছে আছে। কিন্তু সরকারের কাছে দেশীয় শিক্ষার্থীদের জীবনযাপন বিষয়ের তথ্য নেই। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে, যাদের বাবা গ্রামের জমি বিক্রি করে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তিনি তো জমি বিক্রি করে তাঁর সন্তানকে বিদেশেও কাজ করতে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু ওই সব বাবা-মা স্বপ্ন দেখেছেন সন্তান উচ্চশিক্ষিত হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পায়নি সন্তান তবুও যেন উচ্চশিক্ষার স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়।
এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা গ্রাম থেকে এসে শহরে অনেক কষ্ট করে জীবনযাপন করেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে নিজের ভাগ্যকে ঘুরিয়ে নিয়েছে।
এসব গল্প তো অনেকেরই জীবন থেকে নেওয়া। পাবলিক কিংবা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেক রথী-মহারথীরা এমন গল্প হরহামেশাই করেন। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই হওয়া উচিত। সরকারি না বেসরকারি তা দিয়ে এখন বিবেচনার দিন শেষ হয়ে এসেছে।
কর্মক্ষেত্রে এখন সবাইকে লড়াই করেই নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করে নিতে হয়। আমি নিজেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছি। আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাই আমি গর্ববোধ করি। অনেক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে আমরা এগিয়ে যাই। আমাদের এই লড়াইয়ে সরকার তার পকেট থেকে এক টাকাও খরচ করে না। তবু আমাদের তো কোনো অভিযোগ নেই। অন্তত আমাদের এই বেসরকারি উচ্চশিক্ষার খাতের ওপর কর বাড়িয়ে সমস্যায় যেন ফেলা না হয়। এই আশা তো আমরা সরকারের ওপর রাখতেই পারি।
লেখক : ইনচার্জ, গবেষণা বিভাগ, বাংলা ট্রিবিউন