২ মার্চ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়
একটা জাতি-রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন, তা-ও আবার পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতায়। মানে একটা দেশের সংবিধান আছে, তার আওতায় এটা যেমন দুঃসাহিসকতা, ঠিক তেমনি এটা পূর্বকৌশল ছাড়া সম্ভব হতো না। হঠাৎ করে তো হয়ে যাবে না। এটার জন্য একটা পরিকল্পনা লাগে। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে এবং অনুমোদনে আমি, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ, মার্শাল মনি ও হাসানুল হক ইনু স্বাধীনতা পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন।
এটা হয়েছিল তৎকালীন ইকবাল হলে, বর্তমান জহুরুল হক হলে। ১১৬ নম্বর কক্ষে, যেখানে আমি ও শাজাহান সিরাজ থাকতাম। ১৯৭০ সালে।
পতাকাটির নকশা করেন শিবনারায়ণ দাশ। এটি একটি লাল সূর্যের মাঝখানে পূর্ব বাংলার মানচিত্র। কাপড় এবং অন্যান্য কিছু সংগ্রহের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন কামরুল আলম খান খসরুসহ আরো কয়েকজন।
এর আগে বলে রাখি, এটা কোনো ব্যক্তির অর্জন নয়, এটা জাতির অর্জন। ২ মার্চের বর্ণনা করতে গেলে ১, ২ ও ৩ মার্চের কথা আনতে হবে। কারণ, এর একটা ধারাবাহিকতা আছে। বলা যায়, এই তিনটি দিন একেবারে আন্তসম্পর্কিত। ৭ মার্চও কিছুটা সম্পৃক্ত ছিল। ২ মার্চ সম্ভবত কারফিউ ছিল। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন, তখন অর্থাৎ ২ মার্চের আগের রাতেই এক অজানা ফোন থেকে বলা হলো, ‘কাল দুপুরের সংবাদ সম্মেলনের জন্য আপনাদের জন্য খবর আছে।’
আমি ভাবলাম, গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর আসবে। নবাবপুর রোড থেকে একটা রেডিও নিয়ে গেলাম। তখন তো টেলিভিশন এত ছিল না। এটা নিয়ে আমি জগন্নাথ কলেজে গেলাম। সেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের একটা প্রস্তুতি সভা আছে। সবাইকে আগেই বলে রাখলাম, ১২টায় যখন নিউজ শুরু হবে, তখন কিন্তু বক্তৃতা বন্ধ রেখে খবর শুনতে হবে। মিটিংয়ে আছি, মিটিং চলছে, ঠিক ১২টায়; সম্ভবত তখন ১২টায় দুপুরের সংবাদ হতো। তখন প্রথম যে নিউজটা পাঠ করা হলো, সেখানে প্রথম নিউজটাই হলো জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। সঙ্গে সঙ্গে আগে স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, সে জায়গায় হয়ে গেল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, পাঞ্জাব না বাংলা, ‘পাঞ্জাব না ঢাকা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা’, ‘ঢাকা ঢাকা, জিন্না মিয়ার পাকিস্তান আজিমপুর গোরস্তান’, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন হলো’, ওখান থেকে মিছিলসহকারে আমরা কয়েকশ আসলাম ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ পার্ক) ক্রস করে কায়েদে আজম কলেজে গেলাম।
আজকের যে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক, তখন সে আমাদের ছাত্রলীগ শাখার নেতা। তাকে সঙ্গে নিয়ে সে কলেজের সাইনবোর্ড ভাঙলাম। নাম দিলাম সোহরাওয়ার্দী কলেজ। আমি যখন মিছিল নিয়ে নবাবপুর প্রবেশ করেছি, তখন কয়েকশ থেকে হাজার হাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। রাস্তার দুই পাশ থেকে, দোকান এবং দোকানের ওপরে বাসার ছাদ থেকে, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তখন সে রোডে অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। দোকানপাট বন্ধ করে আমাদের মিছিলে অংশ নেয় মানুষ।
তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। কারণ, আগে থেকেই মানুষের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব ছিল। এইটা যখন আগে থেকেই আমার বন্ধু ডাকসুর জিএস মাখনকে বলে রেখেছিলাম যদি এমন কিছু ঘটে, তাহলে তুমি মিছিল নিয়ে বায়তুল মোকাররমে আসবা। আমিও আসব। আমি মিছিল নিয়ে যাচ্ছি, সেও চলে এসেছে। আমাদের কামরুল আলম খসরু, মন্টু এরা সেখানে মহড়া দিচ্ছে। কিন্তু অলংকার দোকান ছিল সেখানে, কেউ সেখানে হামলা করে নাই, কিন্তু অস্ত্রের দোকান ভেঙে ফেলেছে। তখন আইসিসি খেলা চলছিল স্টেডিয়ামে, আমরা গিয়ে খেলা বন্ধ করে দিই। তখন বঙ্গবন্ধু কোরবানী হোটেলে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করছিলেন। আমরা পতাকা নিয়ে, মিছিল করে সেখানে গেলাম। আমরা জিজ্ঞাস করলাম যে, আমরা কী করব? তখন তিনি বললেন, তোমরা তোমার কাজ করো, আমি আমার কাজ করতেছি। আমি পরে জানাব। আরা সেখান থেকে চলে এলাম।
পল্টন মোড়ে নেজামে ইসলামের একটা প্যান্ডেল তৈরি ছিল এবং একেকজন তার ছিঁড়ে একেকদিকে মাইক নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা থামালাম। সেখান থেকে আমরা ঘোষণা দিলাম যে আগামীকাল (২ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আমরা আমাদের ছাত্র জনসভা করব।
বিকেলে ইকবাল হলে আসার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হল নিউক্লিয়াসের নির্দেশে। দাদা সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখের নির্দেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। আগে ছিল সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ; ১১ দফার জন্য। পরে হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।
সকাল থেকে হল থেকে বের হয়ে দেখি, কারফিউর ভেতরে সকাল ৯টার মধ্যে কলাভবন প্রাঙ্গণ, পাশের রাস্তা, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, টিএসসি সমস্ত রাস্তা মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই বাইরে ভিড় রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত ছিল। আর ওপর দিকে আছে ট্যাঙ্ক, গরম পানির গাড়ি, টিয়ার গ্যাসের শেল, ল্যান্ড কামান, এলএমজি এ রকম কয়েক হাজার অস্ত্র সজ্জিত ছিল। আর ওপরে হেলিকপ্টার।
আমার বিরুদ্ধে আগে থেকেই হুলিয়া ছিল। আমি চলাফেরায় দু-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে মুভ করতাম এবং মুভ করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতাম যেন এসবি আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। ১০-১১টার মধ্যখানে আমরা কলাভবনের সামনে বটতলায় আসলাম। আমরা ওখান থেকে মিটিং শুরু করব। এর মধ্যে সমস্ত এলাকায় আওয়াজ শুরু হলো, দেখি না দেখি না, শুনি না শুনি না। মানে তারা আমাদের দেখতে পারছে না। তখন আমরা কলাভবনের পশ্চিম গেটে গিয়ে কলভবনের ওপরে যে চত্বরটা আছে, সে ছাদের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে সভা শুরু হলো। নূরে আলম সিদ্দিকী সভার সভাপতিত্ব করেন। আমার সঙ্গে ছিলেন শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুছ মাখন প্রমুখ। আমরা বক্তৃতা করছি, স্লোগান দিচ্ছি এমন সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভিসির বাসার ওই দিক থেকে বড় বাঁশের মাথায় দেশের মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে আসছে। নির্দেশ ছিল, এটা আমার হাতে দেবে। আমি যখন পতাকা হাতে তুলে ধরলাম, তখন সারা মাঠ থেকে আওয়াজ উঠল ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা’, ‘পাঞ্জাব না ঢাকা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা’, জিন্না মিয়ার পাকিস্তান আজিমপুর গোরস্তান’, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন হলো’। পতাকা দেখে একেকজন লাফ দিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। উত্তেজনা ও রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় অনেকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল এমন অবস্থা। আজকে ভাবতে অবাক লাগে, সেদিন কী করেছিলাম। মানে তখন পাকিস্তান পুলিশ যেভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছিল, একটা করে গোলা ছাড়লে তাহলে মাঠের মধ্যে যে মানুষ ছিল, কেউ বাঁচতে পারত না। যেহেতু পেছনে টান ছিল না, জীবনের জন্য মায়া ছিল না, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের একটা স্বপ্নের মধ্যে ফেলে দেয়। আজকে চিন্তা করলে এ কাজটি করা যেত কি না, ভাবার বিষয়। এটা তো ছিল দেশদ্রোহিতা।
যা হোক, ২ মার্চে পতাকা উত্তোলনের জন্য আমার বিরুদ্ধে ঘোষণা হলো, আমার মাথার দাম ১০ লাখ টাকা। ২ মার্চের সভায় আমরা ঘোষণা করেছিলাম, ৩ মার্চ আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি পালন করব। সে অনুযায়ী ৩ মার্চ লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে আমরা পল্টন ময়দানে কর্মসূচিতে অংশ নেই। সেখানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলাম। সেই ইশতেহার মানে স্বাধীনতার ঘোষণাই বলা যেতে পারে। সে ঘোষণা পাঠে ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলার সর্বাধিনায়ক। এই পতাকা হলো আমাদের জাতীয় পাতাকা। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এটা হবে জাতীয় সংগীত, জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’, জেনারেল এম এ জি ওসমানী সেনাবাহিনীর প্রধান। এবং টোটাল দেশের পরিকল্পনা করা হলো। সেটা হলো ৫৪ হাজার বর্গমাইল নিয়ে এ দেশটা। এর মানে হলো কেউ যেন বুঝতে না পারে আমরা যুক্তবাংলার জন্য আন্দোলন করছি। অর্থাৎ পতাকা ও বর্গমাইল বলার কারণ হলো আমরা যে পূর্ব বাংলার জন্য যুদ্ধ করছি, তা বুঝিয়ে দেওয়া। এই ইশতেহারে আমাদের আলাদা ব্যাংক থাকবে, আমাদের সেনাবাহিনীকে ফেরত দিতে হবে, ওদেরগুলো নিয়ে যেতে হবে। এসব বিষয়ে সার্বিক এটা পড়া শেষ করার পর বঙ্গবন্ধু এসে হাজির হয়ে গেলেন। উনার কিন্তু আসার কথা ছিল না। উনি আসার পর শাজাহান সিরাজ আবার পড়লেন উনারে শুনাইয়া। সভা শেষ করে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার যা বলার আমি ৭ মার্চ বলব। ১ মার্চ, ২ মার্চ, ৩ মার্চ-কে বাদ দিয়ে ৭ মার্চে আলোচনা করা যাবে না। একটি বিল্ডিংয়ের ছাদ পর্যন্ত যেতে হলে নিচের খুঁটি গাড়া লাগে। হিমালয়শৃঙ্গে দাঁড়াতে হলে আগে ছোট ছোট টিলা অতিক্রম করে যেতে হয়। যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করছেন, তাঁরা আসলে বঙ্গবন্ধুকে বড় করছেন না, ছোট করছেন। কারণ এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা না থাকলে বঙ্গবন্ধুও থাকেন না, স্বাধীনতাও আসে না। পতাকা তোলার মধ্য দিয়ে এটা জাতিকে পেছনে ফেরার সুযোগ নাই, সামনে চলার দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছে।
আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ২ মার্চ। আজ ভাবতে পারি না যে এটা আমার দ্বারা সম্ভব হয়েছে। এটা অকল্পনীয় ঘটনা আমার জীবনে।
অনুলিখন : মুহম্মদ আকবর