প্রান্তের কথা
টেলিভিশনের 'রাঁধুনি' সংবাদ!
গণমাধ্যম নিয়ে শহুরে ভাবনা আমি খুব একটা কানে তুলি না। শহরের মানুষের শ্যাওলা মন। অন্দরে পৌঁছানো মুশকিল। অন্যদিকে গ্রামগঞ্জের মানুষের মনের কপাট এখনো খোলা। বাইরে থেকে তার অন্দর জানা যায় সহজেই। সরল মানুষগুলো সরলভাবেই তাদের ভাবনার কথা জানায়। সোজাসাপ্টাভাবে। গণমাধ্যম নিয়ে শহরের মানুষের কাছে কিছু জানতে চাইলে তারা তাদের নিজের রুচিকে আড়াল করে। সাজিয়ে-গুছিয়ে সুশীল জবাব দেবে। কিন্তু প্রান্তের মানুষগুলোর মধ্যে সেই ভণিতা নেই।
টেলিভিশনে কাজ করি। টেলিভিশনকে ভোক্তারা কীভাবে নিচ্ছে? জানতে বরাবরই আমার ভরসা গ্রামগঞ্জের মানুষ।
ঈদ আসছে। দর্শক অপেক্ষায় থাকে টেলিভিশন তাদের জন্য উপভোগের কী ‘খাবার’ নিয়ে আসছে। ‘খাবার’ এই জন্য বলা যে, টেলিভিশনগুলো ভেবে থাকে তারা পর্দায় যা দেবে, তাই ‘খায়’ দর্শক। কিংবা দর্শক যে ধরনের ‘খাবার’ পছন্দ করে, তাই পাতে তুলে দিচ্ছে টেলিভিশন। অনুষ্ঠানের মান নিয়ে টেলিভিশনের দিকে যে অভিযোগে অঙ্গুলি তুলে ধরা হয়, সেটি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে দর্শকের দিকেই। বলা হচ্ছে, দর্শক তেমন চায় বলেই টেলিভিশন এমন অনুষ্ঠান তুলে দিচ্ছে পাতে। দর্শকদের প্রতি তাদের রুচি নেমে যাওয়ার যে অভিযোগ তুলে দেওয়া হচ্ছে তা কি সত্য? বাস্তবতা কি তাই?
এ প্রশ্নের উত্তরপত্র ভোক্তাদের কাছে। সেখান থেকে যা জানা গেল, তা হচ্ছে দর্শকের রুচি নষ্ট হয়নি। তার পাতে ভালো ‘খাবার’ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে টেলিভিশন। বিনোদনে ক্ষুধার্ত দর্শক তাদের উপযোগ মেটাতে পাতে যা পাচ্ছে, তাই খেয়ে নিচ্ছে। অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে। বিটিভি যুগের দর্শকের চোখ এখন চালসে। সেই প্রবীণ চোখও যা খুশি তাই দেখে বিনোদনের ক্ষুধা মেটায়। অথচ এই চোখের বিটিভিতে যে মানের নাটক বা অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তা হদিস এখন পাওয়া যায় না। দেশে টেলিভিশনের সংখ্যা বেড়েছে। শুরুতে বেসরকারি চ্যানেলগুলো বিটিভির ধারাবাহিকতায় ভালো মানের নাটক- অনুষ্ঠান তৈরি করত। এখন সবকিছুই বাজার চলতি ‘চিপস’ অনুষ্ঠান।
এই ‘চিপস’ধর্মী নাটক বা অনুষ্ঠান দর্শক কতটা চোখে তুলছেন? রকমারি জরিপ বলছে, দর্শকের পাতে এখন ভারতীয় ‘খাবার’। নাটক বা রিয়্যালিটি শোর জন্য তাদের কাছে ভারতীয় ‘খাবার’ই পছন্দ। যদিও সেই অনুষ্ঠান বা নাটকেও রয়েছে একঘেয়েমি। অরুচি ধরে গেছে এরই মধ্যে। এখানকার টেলিভিশনগুলো সেই কথা আঁচ করতে পেরেছে। সেই সঙ্গে সমাজের মধ্যে এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনও চোখে পড়েছে তাদের। তারা আমদানি করে নিয়ে আসতে শুরু করল আরব গল্পের নানা সিরিয়াল। দর্শক চেখে দেখল নতুন ফর্দ। তার প্রভাব বাজার-সমাজ দুই জায়গাতেই পড়ল। হুমড়ি খেয়ে এই একই ‘খাবার’ সবাই মিলে খাওয়াতে শুরু করল দর্শকদের। টেলিভিশনগুলো বলতে শুরু করল, দর্শক খাচ্ছে তাই খাওয়াচ্ছি। যেমনটি তারা বলছে ‘ভাঁড়ামি’ নাটক—সিরিয়ালের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে।
টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে দেখা যায়, এখানে যারা নানা উপলক্ষে রান্না করছেন বা শেখাচ্ছেন, তারা আসলে হেঁসেলের প্রকৃত রাঁধুনি নন। ছেলে কিংবা মেয়ে উভয়ের বেলাতেই একই কথা। তাদের তারকা খ্যাতির বলে তারা কয়েক মিনিটের রাঁধুনি হয়ে উঠছেন। প্রকৃত রাঁধুনিদের টেলিভিশন পর্দায় জায়গা নেই। যেমনটি নেই অনুষ্ঠান নির্মাণের মূল রাঁধুনিদের। কী কী উপকরণ দিয়ে কেমন অনুষ্ঠান তৈরি হবে, সেই রেসিপি তৈরি করতেন অনুষ্ঠান প্রযোজকরা। অনুষ্ঠান বিভাগ। এখন সেই রাঁধুনির জায়গাটির দখল নিয়েছে বিপণন বিভাগ। তারা ‘চিপস’-‘ঝালমুড়ি’র মতো হালকা স্ন্যাকসের বাজার চলতি অনুষ্ঠানের দিকই টেলিভিশনগুলোকে নিয়ে গেছে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ পড়েছে তাদের এই ভুল আভাস ও তথ্যের ফাঁদে। ফলাফল ভোক্তার পাতে তুলে দেওয়া ‘খাবার’ পাতেই পড়ে থাকছে। চেখে দেখার মানুষ কমছেই।
ঈদ আসতে দেরি নেই। টেলিভিশনগুলো ঈদ অনুষ্ঠানের লোভনীয় প্রমো প্রচার শুরু করেছে। এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শকদের জিভে জল এলো কি না, জানতে গ্রামগঞ্জের দর্শকের কাছে গিয়েছিলাম। চায়ের দোকান, কোনো বাড়ির বৈঠকঘর, কোথাও দর্শককে দেশি চ্যানেলে পাইনি। বিদেশি চ্যানেল থেকে চোখ সরিয়ে উত্তর দিয়েছেন, ‘জানি কী দেখাবে। ওই হাসি-ঠাট্টা। সব চ্যানেলে কিছু পরিচিত মুখের ভাঁড়ামি। সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর চেষ্টা।’ নতুন খাবার পাতে উঠবে, সেই ভরসা কারো নেই। দু-একজন যাঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রমো তবু দেখেছেন তাঁরাও বললেন, এক খাবার কতক্ষণ খাওয়া যায় বলেন? সাত দিন ধরে বিশ-বাইশ চ্যানেলে একই খাবার। ওই খাবার হজমের হজমি কই?
আমাদের টেলিভিশন উপাদেয় সুষম অনুষ্ঠান তৈরির রাঁধুনি সংকটে আছে সত্যি। তবে রাঁধুনি-শূন্যতা নেই। এখনো সুষম অনুষ্ঠান তৈরির মতো নির্মাতা আছেন প্রায় সব চ্যানেলেই। তাদের যদি এখনো তাদের মতো করে রাঁধতে দেওয়া হয়, তবে স্বাদের বৈচিত্র্যময় ‘অনুষ্ঠান’ আবারও ফিরে আসবে। প্রয়োজন শুধু যাদের ‘খাবার’ বিপণনের কথা, তাদের ‘ খাবার’ তৈরির হেঁসেল থেকে দূরে রাখা।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টেলিভিশন।