প্রতিক্রিয়া
পিশাচদের নির্মূল অপরিহার্য
পিশাচ! হ্যাঁ পিশাচ ছাড়া অন্য কোনো ঘৃণ্য নামে এদের সম্বোধন করা যায় না। জানোয়ারদেরও মমতা থাকে কিন্তু এই পিশাচদের নেই। মানুষের মুখোশ পরে এই পিশাচেরা নির্মমতার শীর্ষে উঠে ছিঁড়ে খায় ছোট ছোট নিষ্পাপ প্রাণ। প্রথমে রাজন, তারপর ইয়াছিন ও নাসির আর দিন না যেতেই রাকিবের মতো শিশু হত্যার পৈশাচিক নাট্যলীলা ঘটে যায় আমাদের সামনে। অনেকগুলো আবার প্রকাশই পায় না। পৃথিবী থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ঝরে যায় তাজা তাজা ফুল অথচ এর কতটুক রোধ করতে পারি আমরা?
প্রতিবছর সারা বিশ্বে পালিত হয় মানবাধিকার দিবস, শিশু অধিকার দিবস আরো কত কত দিবস তার লেখাজোকা নেই। কিন্তু কাজের কাজ হয় কতটুকু? তারপরেও একের পর এক চলতে থাকে শিশুহত্যা। তাও অভিনব নারকীয় উপায়ে। কেউ রড দিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় গুঁড়া করে, কেউ বা কমপ্রেসারের গ্যাস শরীরে ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে দেয় অসহায় শিশুকে। যখন তারা চিৎকার করে ‘হাড্ডিতে মাইরেন না’, যখন তাদের কাতর স্বরে ধ্বনিত হয় ‘মামা আর দিয়েন না’ তখন তাদের সেই করুণ আর্তনাদে এই পিশাচদের মন গলে না। পৈশাচিক আনন্দে দলগতভাবে তারা উল্লাস করতে থাকে। যাদের মনে মায়ার ছিটে ফোঁটাও নেই, নেই কোনো মানবিকতার রেশ তারা মানবসমাজে মানুষ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তিই এদের প্রাপ্য।
কোন সভ্যতায় বাস করছি আমরা? হাজার বছর আগে নরখাদকেরা যখন মানুষ ধরে খেত, তখন তারাও বুঝি এই পিশাচদের মতো এত বর্বর ছিল না। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় এইসব অত্যাচার আর হত্যার প্রতিবাদ করা হয় ঠিকই কিন্তু এর পরিণতি কখনোই ফলপ্রসূ হয় না। প্রথম কয়েকদিন চলে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ, তারপর আবার যা তাই। পুলিশি দুর্নীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর টাকার দাপটে বারবার এরা উপযুক্ত শাস্তি থেকে পার পেয়ে যায়। এদের ঘৃণ্য কাজের জন্য নজির স্থাপনকারী শাস্তি আজও বাংলাদেশ সরকার কোনো শিশু হত্যার অপরাধীকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আজও আমরা প্রতিনিয়ত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে দেখি অসহায় শ্রমজীবী শিশুদের। তাহলে কোথায় আমাদের আইন? কোথায় শিশু অধিকার? কোথায় সরকারের শিশু নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি? কোথায় আইনের বাস্তবায়ন? মুখে মুখে ফাঁকা বুলি ঝরিয়ে, আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে যেসব আইনরক্ষক চিঁড়ে ভেজান তাদের শনাক্ত করার সময় এখন এসেছে। বাইরে আইনের লেবাস লাগিয়ে পেছনে যাঁরা দুর্নীতির নীতিটাকে সর্বদাই মান্য করে চলেন ও সহায়তা দান করেন, এসব নরপিশাচের মুক্তিদানে তারাও কম অপরাধী নন। যদি আজ একমাত্র আমাদের পুলিশ প্রশাসনই তাদের দায়িত্ব অর্ধেকও সঠিকভাবে পালন করত, তবে এই জঘন্য দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যখন ভূত তখন আর অন্যকে দোষারোপ করে লাভ কী?
আজ অমানবিকতা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। কোনো স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এ ধরনের নারকীয় হত্যা সহ্য করা সম্ভব নয়। এই পিশাচদের যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা আজ জাতির কাছেই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আজ সরকার এই পিশাচদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে বুঝতে হবে সেদিন খুব দূরে নেই, যখন ঘরে ঘরে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাতে কারো হাত কাঁপবে না। এবং যদি তাই হয় তবে কী ভয়ংকর ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা সহজেই অনুমেয়।
এখনই সময় যখন সরকার একটি দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারে শিশুর নিরাপত্তা। অন্তত বন্ধ করতে পারে নৃশংস শিশুহত্যা। এর জন্য জরুরি পুলিশ প্রশাসনের একটু সচেতনতা ও সুনীতির চর্চা। অবাক করার মতো বিষয় রাজন হত্যার প্রধান অপরাধী কামরুল ইসলাম, রাকিব হত্যার আসামি শরীফ ও মিন্টু, নাসিম ও ইয়াসিনের হত্যাকারী গোলাম মোস্তফার কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আজও কার্যকর হয়নি। উপরন্তু পুলিশ প্রশাসনের ওপর এসেছে যথাচরিত দুর্নীতির অভিযোগ। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সোচ্চার হওয়ার দিন এখনই। এখনই সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এসব অভিযুক্ত পিশাচদের শাস্তিদানের। নইলে অচিরেই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ সম্পূর্ণরূপে আস্থা হারাবে সরকার ও তার পুলিশ প্রশাসনের ওপর।
একটি জীবনের বিনিময় কী হতে পারে? না কোনো কিছুর বিনিময়ে একটি নিষ্পাপ জীবন ফিরিয়ে আনা যায়? হয়তো এই শিশুটিই হতে পারত নজরুল, হতে পারতো মুজিব কিংবা একজন আবুল কালাম। কিন্তু পিশাচদের নির্মমতায় এমন অগণিত ভবিষ্যৎ ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। যার প্রতিকার আজ একান্ত জরুরি। যদিও কোনো কঠোর শাস্তি এদের অপরাধের জন্য কম হবে তারপরেও এই পিশাচদের কৃতকর্মের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা ও তা খুব শিগগির বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি। এই পিশাচদের নির্মূল করাও আজ অপরিহার্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।