মানুষের কাছেই বিস্ময় এবং চমকে উঠার জাদু
আজকাল আমরা চমকে উঠছি হরদম। মানুষের স্বাভাবিক অভ্যেস বিস্মিত হওয়া। বিস্মিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুনকে জানার বা আবিষ্কারের পথে হাঁটা শুরু। এখন তো চমক বা অবাক করার মতো উপকরণের শেষ নেই। নিত্য নতুন নতুন উপকরণ যোগ হচ্ছে। ভোর হওয়ার আগেই বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তি। বলা যায় প্রযুক্তির এখন ভরা মৌসুম চলছে। যন্ত্র সভ্যতা এই সময়ের মতো এতটা হয়তো সুফলা ছিল না। যুদ্ধ সরঞ্জাম, উড়োজাহাজ, গাড়ি, কম্পিউটার থেকে শুরু করে সেলফোনটি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একটি মডেলে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই পরেরটি এসে জায়গা করে নিচ্ছে। বলা যায় অনেকটা জোর করেই।কারণ নতুনটি যে প্রযুক্তি সঙ্গে নিয়ে আসছে, তাতে সদ্য পুরোনোটির চেয়ে কয়েক গুণিতক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দামে সাশ্রয়ী, ব্যবহারে সহজ। একই সঙ্গে প্রযুক্তির একধাপ উত্তরণও ঘটে। ব্যক্তিগত ভাবে যে পেশার সঙ্গে জড়িত, সেখানে টেলিভিশন, বেতার, সংবাদপত্র এবং অনলাইন প্রতিমুহূর্তেই লড়াই করছে প্রযুক্তির সঙ্গে। আজ যেই যন্ত্র বা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় বলে, কাল সেটির আর প্রয়োজন থাকছে না। পরিণত হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ‘বর্জ্যে’। সর্বোপরি লেখাপড়া এবং পেশাগত কাজে আমরা যন্ত্র সভ্যতার মধ্যে নিজেকে বিলিয়েই দিয়েছি। এখন আমাদের সব প্রত্যাশা যন্ত্রেরই কাছে। স্বীকার করে নিচ্ছি-প্রযুক্তি প্রায় সব পেশার সেবা ও মানে উৎকর্ষ এনে দিয়েছে। পথের যানজটের সময় অপচয়ের গানিতিক হিসাব বড় অঙ্কে দাঁড়ালেও, ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি –বেসরকারি সেবা প্রযুক্তি কল্যাণে সহজেই মিলছে। সেখানে কমেছে সময়ের খরচ। সবকিছুর ফলাফল হিসেবে দেখতে পাচ্ছি-আমাদের সব বিস্ময় এবং চমকের দাবি এখন যন্ত্রের কাছেই। মানুষের কাছ থেকে কোনো বিস্ময় বা চমক আশা করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি।
বিস্মিত করতে পারেন, চমকে দিতে পারেন এমন মানুষ হারিয়ে গেছে, তাঁরা বিলুপ্ত? মোটেও নন।তাঁরা আছেন। তাঁদের সংখ্যাও কমে যায়নি। তাঁরা তাঁদের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। আমরাই তাঁদের দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছি না। আমাদের সময় কেড়ে নিয়েছে প্রযুক্তির কিছু খুচরো উপকরণ। ফেইসবুক, ওয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবে আমরা মনোযোগী এখন। সব বিস্ময়ের খনি ভাবছি এই অ্যাপসগুলোকে। কবিতা, গল্পের স্বাদ পেতে বইয়ের পাতায় নয়, হণ্যে হয়ে ঘুরি ফেইসবুক, অ্যাপসে। অ্যাপসকে আমরা আলাদিনের চেরাগ ভেবে বসে আছি। কিন্তু আমাদের পাশেই যিনি প্রকৃতি, মানুষ ও জীবনের জ্ঞান নিয়ে বসে আছেন। আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান গোলকের সব সুন্দর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। অযুত মানুষই তো কত কত আবিষ্কার করছে, মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন, পৃথিবীকে, এই সৌর জগত বা তার বাইরের জগতকে নানা ভাবে দেখছে, সেই দেখার সঙ্গে আমরা যোগ দিতে পারছি না। এখন যন্ত্র মানবরা এসে আমাদের চমকে দেয়। বিস্মিত করে।
মনে পড়ে একজন মোহাম্মদ আলী ক্লে বাংলাদেশে যখন এসেছিলেন, অধুনা বিশ্বসেরা মেসি যখন ঢাকার মাঠে খেললেন, শচীন-লারা, তাঁদের আগে গাভাস্কার-ইমরান খান যখন খেলেছেন আমরা তাদের নৈপুণ্যে বিস্মিত হয়েছি। এখনো বিস্মিত হতে বোল্ট, ফেলেপস, আমাদের মাশরাফি, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ কিংবা প্রমীলা ফুটবলারদের চৌকস নৈপূণ্যে। আবুল হাসান, সুকুমার বড়ুয়া, শামসুর রাহমান তাঁদের ছড়ায় কবিতায় আমাদের আপ্লুত করতেন। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বিস্ময় মানুষগুলো এখনো আমাদের পাশে আছেন। আমরা তাঁদের কতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছি? একজন কৃষককে, শ্রমিককে দেখে কেন আমরা চমকে উঠতে পারছি না। এখনো অসাধারণ কবিতা, গল্প ,নাটক লেখা হচ্ছে।
ছবি আঁকা হচ্ছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। আমাদের সেদিকে ফিরতে হবে। বলতে চাই আমাদের ফিরে তাকাতে হবে মানুষের দিকেই। মানুষের চেয়ে বিস্মিত করার ক্ষমতা আরো কারো হতে পারে না। মানুষ এবং তার চারপাশের প্রকৃতি-নদী, অরণ্য, ময়দান, আকাশ আমাদের মনে যে বিস্ময় জাগাতে পারবে, যন্ত্র সেই ক্ষমতা পাবে না কখনোই। তাই বলে যন্ত্রকে এড়িয়ে যাব না আমরা। যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়বে, সেবা বাড়বে। আমরা যেন কখনোই যন্ত্রের দাস না হয়ে উঠি। যন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ মানুষেরই থাকবে। আমরা ভুল করে, ভুল প্ররোচণায় যন্ত্রের গান গাইতে শুরু করেছি, কিন্তু আমাদের মানুষ ও প্রকৃতির জয়গান গাইতে হবে সুন্দর জীবন ও পৃথিবীর স্বার্থে।
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি