অভিমত
৫৭ পারেনি, ৩২-ও পারবে না
সাংবাদিকতা এখন ধারাপাতের মধ্যে পড়ে গেছে। মুক্ত এবং স্বাধীন ধারণার যে অবারিত প্রাঙ্গণ ছিল, সেখানে গাণিতিক ধারা দিয়ে চৌহুদ্দি ঠিক করে দেওয়া আছে। চৌহুদ্দির দেয়াল বা দাগ ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না। দেয়াল পেরিয়ে যাওয়া তো পরের কথা, ছুঁলেই শাস্তি। আমরা দেখেছি, ২০০৬ সালে তৈরি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ছিপে আটকা পড়েছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। এ ছাড়া খুলনার সাংবাদিক লতিফ মোড়ল, রৌমারীর সাংবাদিক আনিসুর রহমান, ময়মনসিংহের ত্রিশালের দুজন অনলাইন সাংবাদিকসহ ১৯ সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর ১১টিরই বাদী ছিলেন সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী। যদিও তথ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ৫৭ ধারায় খুবই নগণ্য সংখ্যক সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা সাংবাদিকদের অনুসন্ধান বা রিপোর্টে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ক্ষুব্ধ হয়েই তাঁরা সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে ৫৭ ধারাকে ব্যবহার করেছেন। মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনেকটা স্বীকারোক্তিমূলক বলেই মনে হলো। তিনি বলেছেন, সংসদ সদস্যদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ করা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী খোলামেলাভাবেই বলেছেন, তিনি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাঁদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাঁদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তাঁরা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়ে। তিনি অবশ্য এও বলেছেন যে, গণমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতে এ আইন করা হলেও আমার বিশ্বাস আপনাদের (সাংবাদিক) ঠেকানো যাবে না।’
আমরা যদি ৫৭ ধারার দিকে ফিরে তাকাই, দেখব ৫৭ ধারায় বলা হয়েছিল, '(এক) কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (দুই) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
২০১৩ সালে এই আইনে সংশোধনী এনে কারাদণ্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি করে অন্যূন সাত বছর এবং অনধিক ১৪ বছর করা হয়। ধারাটি প্রথম থেকেই ছিল অজামিনযোগ্য, কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬-এর সব ধারাই ছিল অ-আমলযোগ্য। যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। নতুন সংশোধনীতে এই আইনকে আমলযোগ্য করায় পুলিশের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকল না। পুলিশ চাইলেই যেকোনো সময় যে কাউকে এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গ্রেপ্তার করতে পারবে।’
এ আইনকে ব্যবহার করে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগও উঠেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ৫৭ ধারা বিতর্কিত হয়ে ওঠে এবং আইনটি বিলুপ্ত করার দাবি ওঠে। এই দাবি যে শুধু গণমাধ্যমকর্মীদের দিক থেকে উঠেছিল তা নয়, দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেও এই ধারা বিলুপ্তির দাবি উঠে আসে। কারণ সংবাদপত্রের যাঁরা সাধারণ ভোক্তা, তাঁরা দেখছিলেন ৫৭ ধারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। ভীত গণমাধ্যম বিব্রতবোধ করছে সত্য তথ্য তুলে আনতে। ফলে সাধারণ মানুষের দিক থেকেই জোরালো হয়ে ওঠে ৫৮ ধারা বিলুপ্তির দাবি।
সরকার যেন সেই দাবি পূরণে এগিয়ে এলো। আপাতভাবে তাই মনে হচ্ছিল। এলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে অনুমোদিত খসড়া থেকে জানা গেছে, এর ১৪টি ধারা জামিন অযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন আইনের ধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ৩২ নম্বর ধারা। যেখানে বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। শাস্তি : ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আপত্তি উঠেছে, এই 'গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ' জায়গাটি নিয়ে। গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, সাংবাদিকদের কাজের ধরন তো একপ্রকার গুপ্তচরবৃত্তির আদলেই। অনেক তথ্য, অনিয়ম-দুর্নীতির কাগজ ও ছবি গণমাধ্যমকর্মীদের গোপনেই সংগ্রহ বা গ্রহণ করতে হয়। অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতার প্রধান কাজই হচ্ছে এই পদ্ধতির অনুসরণ। এখন তাকে গুপ্তচরবৃত্তির 'পতাকা চিহ্নিত স্টিকার' দিয়ে দেওয়ায় অনুসন্ধান সাংবাদিকতাকে কি হত্যা করা হলো? এমন প্রশ্ন উঠেছে গণমাধ্যমকর্মীদের দিক থেকে।
তাঁরা শঙ্কিত এই ভেবে যে যেমন করে ৫৭ ধারা ব্যবহার করে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থে সাংবাদিক কোন কোন ক্ষেত্রে নিরপরাধ সাধারণ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবার ৩২ ধারাকে নিয়েও তা শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরাই এখন একমাত্র লক্ষ্য ও কেন্দ্র। শঙ্কিত হলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থেমে যাবে। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা ওয়াকওভার পেয়ে যাবেন না। কারণ, সত্য খবরকে কোন আইনের ভয় দেখিয়ে হত্যা করা সম্ভব নয়। আমি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে বলতে চাই, সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের যে কারো দুর্নীতি ও অনিয়মের সত্য খবর তুলে আনবেন। সত্য প্রকাশ গুপ্তচরবৃত্তি হবে না আইনমন্ত্রী বলেছেন। প্রশ্রয় নিতে চাই বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা থেকে, আইন করা হলেও (আমাদের) ঠেকানো যাবে না। বিশ্বাস করুন সত্যিই আমাদের ঠেকানো যাবে না। ৫৭ পারেনি, ৩২-ও পারবে না।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি।