অভিমত
নেশা-অপরাধের জগতে নিমগ্ন প্রজন্ম
স্কুলবেলা থেকেই ধনীর দুলালদের দূর থেকে দেখেছি। স্কুল বেঞ্চে পাশাপাশি বসে থেকেও, তারা ছিল যোজন দূরের। তাদের দুধ সরবত খাওয়া দেখে শুধু ঢেঁকুর তুলেছি। মহল্লায়, স্কুলে হামাগুড়ি দিয়ে মাত্র উঠতে শেখা শিশুটিরও ছিল দম্ভ। পিতার, কিংবা বংশের তথাকথিত কৌলিণ্যের আগুনে জ্বলে উঠা এই দুলাল-দুলালীদের আগুনে ভস্ম হয়েছি আমরা। যারা ছিলাম মধ্য এবং তার নিচের সীমারেখার বিত্তের মধ্য থেকে আসা। দেখেছি তাদের বিত্তের ঝলকে স্কুলে শিক্ষকদের কাছে বাড়তি প্রশ্রয় পাওয়া। তাদের বখাটেপনায় কেমন নিশ্চুপ হয়ে যেত মহল্লা। বরাবরই তারা সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির। আমরা বঞ্চিতের মিছিলে। এই সুবিধা স্কুল-মহল্লা পেরিয়ে থাকা পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে দেখেছি। কোন ধনীর দুলাল খেয়ালের বশে মহল্লায় তার বয়সী কাউকে মারধোর করলো, বুকে ছুড়ি চালিয়ে দিলো এমনকি হত্যা করে বসলো। তা দেখে, তাকে বাঁচাতে আদুরে মানুষের অভাবি দেখিনি কখনো।
বড় লোকের দুলালরা এমন খেয়ালীপনা করতেই পারে। তারা মটরসাইকেল, মটরগাড়ি নিয়ে গর্জন করে এলাকা, শহর মাতাবে, এটা যেনো নগরের গৌরব। মহল্লার আভিজাত্য। সেই মটরের নিচে চাপা পড়লো যে মানুষ-সে অসভ্য ছাড়া আর কি হতে পারে? এই মূহুর্তে খেয়ালী ধনীর দুলালের মোটর গাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ারের কথা। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের কথা। তারপর কি আর কোন অসভ্য মানুষ নিজেকে সঁপে দেয়নি বড়লোকের সন্তানের মোটরের নিচে? এইতো ধানমন্ডির সাতাশ নম্বরে এক ধনীর দুলাল ফুটপাতে গাড়ি তুলে দেয়ার বীরত্ব দেখাল। ব্যস প্রাণ গেল মধ্যবয়সী এক প্রবাসীর। অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ধনীর দুলালের শখ হয়েছিল গাড়ি চালাবার। পথে নেমে রিকশা যাত্রী স্কুল ছাত্রকে তার অভিভাবকসহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল বহুদূর। গুলশানে শিল্পপতির সন্তান মোটর নিয়ে নগর কাঁপাতে নেমেছিল। সেই কম্পণে মৃত্যু হয় এক পথচারীর। কেবলই কি মোটরগাড়ি নিয়ে তান্ডব? ছেলেবেলাতেই দেখে আসছি মাদক নিয়ে তাদের মাতম। ছেলে-মেয়ে উভয়কেই দেখেছি। ছিল মেয়ে অপহরণের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েরাও যে সেই অ্যাডভেঞ্চারে স্বেচ্ছায় যোগ দেয়নি এমন নয়। স্কুল পেরিয়ে কলেজ –বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চিত্রনাট্য চলেছে। তখনো তারা নানা বাহিনী,দল এবং গোত্রে বিভক্ত ছিল। একেক বাহিনীর নাম-ডাক হুঙ্কারে দশদিক কেঁপে উঠতো। বখাটে সন্তানের বেহিসাবে বাবা-মায়ের সম্পদ ছিল একেকটি বাহিনীর নষ্টামীর রসদ।
তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় পা রেখে ধনীর দুলাল-দুলালীরা আরো বেপরোয়া। নৈতিক শৃংখল ছেঁড়া। সঙ্গে আছে আছে বাজারী দুনিয়ার দ্বিতীয় নাগরিকত্ব। এখানে তাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেনের নাম মাদক। স্বপ্নের রঙ মাদকের নীল। উদযাপন বলতে তারা বোঝে ধ্বংস। ধবংসের সিম্ফনীই তাদের প্রিয় সুর। আগে মহল্লা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছিল তাদের বাহিনী, দল বা গোত্র। কিন্তু এখন তারা সীমান্ত ভেঙ্গে দিয়েছে। দেশ, বিদেশ জুড়ে তাদের দল বাহিনী। এক বাহিনী, অপরকে উৎপাটন করার রণযুদ্ধে মত্ত। শুধু মুখোমুখি নয়, ফেইসবুকে চলে গ্রুপ গঠন এবং লড়াই। এদের কাজ এলাকাতে আধিপত্য বিস্তার , স্কুল-কলেজে র্যাগিং করা, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, উচ্চ শব্দ করে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরী এবং ছিনতাই ও অশ্লীল ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করা। ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের সঙ্গেও জড়িত তারা।
এই ধনীর দুলালরা টাকা ও মাদকের বিনিময়ে তাদের সেবাদাস হিসেবে নিম্নবিত্তের সন্তানদেরও ব্যবহার করে। পাড়া, স্কুল, কলেজ এবং কোন কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক দল আছে তাদের। দলের নাম গুলোও বিচিত্র -রিচ কিডস, ডিসকো বয়েজ, কাঁকড়া, কে নাইট, ফিফটিন, নাইনস্টার, নাইন এম এম, ব্ল্যাক গালর্স ..। তারা তাদের কর্মকাণ্ড আড়ালে রাখেনা। আন্ডারগ্রাউন্ড বাহিনী এরা তাও বলা যাবেনা। কারণ এই দলগুলো ফেসবুক এবং এলাকা ভিত্তিক দেয়াল লিখনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান ও দাপটের জানান দেয়। হোটেল, রেষ্টুরেন্টে মাদক সেবন, বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে ফূর্তিতে মেতে থাকায় তাদের কোন রাখঢাক বা লাজ নেই। পথেও তারা প্রকাশ্য।
তবে আমরা কেন তাদের রুখতে পারছিনা, দমাতে পারছিনা? সমাজ নিশ্চুপ, প্রশাসনের আলসে? এটি কোন কঠিন হিসেব নয়। সহজ অঙ্ক। বরাবরই যে ব্যক্তির কাছে, যে পরিবারের কাছে, যে গোষ্ঠীর কাছে বেহিসেবি অর্থ এসেছে, যে অর্থের নৈতিক রঙ কালো, সেই অর্থকে দেখানোর জন্য মন উচাটন ছিল ঐ ব্যক্তি, পরিবার এবং গোষ্ঠীর। এবং অর্থকে,প্রতিপত্তিকে দৃশ্যমান করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সন্তান। তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে খেলনা অস্ত্র, দামি গাড়ির মডেল খেলনা, লোভনীয় খাবার-পোশাক। তাকে বোঝানো হয়েছে রাজকুমারীই তার প্রাপ্য। ছোটবেলার সেই দীক্ষা প্রাপ্ত হয়ে বড় বেলায় এসে ঐ সন্তানই অস্ত্র হাতে নিয়ে দখলে নিতে চেয়েছে গাড়ি এবং রাজকুমারীকে। সঙ্গে ভোগের ষোলআনা। কোন পরিবার সেই ভোগের যোগান দিতে পেরেছে আগের সোনার চামচেই। যারা পারেনি, তাদের সন্তানরা নেমে পড়েছে জোর জবরদস্তিতে আদায় করে নেয়ার হল্লাতে। আমাদের সন্তানদের এমন হল্লাতে নামিয়ে দিয়ে আমরা কি করে নিরপরাধ থাকি?
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন