কিম-ট্রাম্প বৈঠকের ভবিষ্যৎ কী?
দীর্ঘ দিনের নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা সমাপ্তি ঘটিয়ে সিঙ্গাপুরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, উভয় নেতা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি করেছেন। বৈঠক সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, ‘এটি খুব ভালো হয়েছে। আমাদের সব সমালোচনা, অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক দারুণ।’ আর কিমের সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমরা শান্তির লক্ষ্যে কাজ করব। অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা সব সমস্যা কাটিয়ে এই আলোচনার টেবিলে বসেছি।’ উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে যে জল্পনা-কল্পনা চলছিল, সেই প্রসঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্পের দাবি, ‘শিগগিরই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ শুরু করবে উত্তর কোরিয়া।’
তবে কিম কিংবা ট্রাম্প দুজনকেই বোঝা মুশকিল। পরবর্তী সময়ে তারা শান্তির পথে থাকবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও শঙ্কা রয়েছে। কিম তার দেশের মজুদকৃত পরমাণু অস্ত্র চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে রাজি হবেন কি না- এমন প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাপক খাচ্ছে। অন্য দিকে উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে যে প্রায় সাড়ে ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা মজুদ রয়েছে, তা সরিয়ে নিতে ট্রাম্প রাজি থাকবেন কি না- সেটিও বড় প্রশ্ন। তবে নানা শঙ্কা ও সংকটের মধ্যে স্বস্তির বিষয় হলো, দুই দেশের নেতাদের মধ্যে এই প্রথম এ ধরনের কোনো বৈঠক সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো।
নিকট অতীতে দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেগুলো দূরীভূত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছার বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্বপ্নের মতো। এ কারণেই হয়তো কিম বলেছেন, আমরা একটি ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছি এবং অতীতকে পেছনে ফেলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই বৈঠক হওয়ার জন্য ট্রাম্পকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান কিম।
ট্রাম্প ও কিমের যৌথ ঘোষণার প্রধান তিনটি বিষয় রয়েছে। সেগুলো হলো : শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দুই দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী ইউএসএ-ডিপিআরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী শান্তির শাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও ডিপিআরকে তাদের উদ্যোগ যুক্ত করবে। এমনকি কোরীয় উপদ্বীপকে পুরোপুরি পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করতে ডিপিআরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করার পর ট্রাম্প উচ্ছসিত হয়ে বলেন, আজকে যা হলো তার জন্য আমরা অত্যন্ত গর্বিত। আমরা দু’জনেই চাই কিছু করতে। এছাড়াও এই বৈঠকে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সামরিক মহড়া বন্ধ করবেন ট্রাম্প। কোরিয়া উপদ্বীপে ওই যৌথ মহড়াকে ‘খুবই উসকানিমূলক’ এবং ‘ব্যয়বহুল’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। উত্তর কোরিয়াকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া প্রতি বছরই নিয়মিত এ সামরিক মহড়া করে আসছে। এ মহড়াকে ‘যুদ্ধের উসকানি’ বলেই মনে করে উত্তর কোরিয়া। কাজেই এই বৈঠকের মাধ্যমে এ দিকটাও অত্যন্ত ইতিবাচক মনে করছেন কূটনীতিকরা।
ট্রাম্প বলেন, প্রকৃত পরিবর্তন যে সম্ভব তা প্রমাণিত হয়েছে। এখন আমরা একটি নতুন ইতিহাস, একটি নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য প্রস্তুত। বৈঠকে কিমের সাথে মানবাধিকার নিয়েও কথা হয়। ট্রাম্প বলেন, ভবিষ্যতে এ বিষয়টি নিয়ে আরো বিশদ আলোচনা হবে। কোরীয় যুদ্ধে আটকে পড়াদের ফেরত পাওয়ার আকুতি জানিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অসংখ্য মানুষের কল, চিঠি ও টুইট আমার কাছে আসে। তারা তাদের ছেলেমেয়ে, বাবা-মাকে ফেরত চান। আমি এটি নিয়ে কথা বলেছি। শিগগিরই ৬০০০ বন্দিকে ফেরত পাঠানো হবে।
নানা কারণে এ বৈঠকটি বিশ্বের সবটুকু নজর কেড়ে নেয়। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল। কথার লড়াইয়েও শামিল হয়েছিল কিম ও ট্রাম্প। সে কথার লড়াই গিয়ে ঠেকে ব্যক্তিগত আক্রমণে। এসব কারণে এ বিষয়ে কিমের অনুভূতি খুবই চমকপ্রদ। তিনি বলেন, ‘এ পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। ইতিহাস আমাদের হাত-পা জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রেখেছিল। পুরোনো ধ্যান-ধারণা ও অভ্যাস আমাদের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমরা সেসব অতিক্রম করে এগোতে সক্ষম হয়েছি এবং এখানে এসে হাজির হয়েছি।’
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর ফল কোন দিকে গড়াবে সেটা এখনো পরিষ্কার করে অনুমান করা কঠিন। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষরের পর বিবৃতিতে যা বলা হয়নি, সংবাদ সম্মেলনে সে কথাও ঘোষণা করেন। ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি উত্তর কোরিয়াকে ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা’ দিচ্ছেন। বিনিময়ে কিম কোরীয় উপদ্বীপকে বিপারমাণবিকীকরণে তাঁর ‘দৃঢ় ও অবিচল প্রতিশ্রুতি’ দান করেন। যৌথ বিবৃতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে অনুচ্চারিত থেকে যাওয়া বিষয়গুলো। উত্তর কোরিয়ার প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম কর্মসূচি বন্ধ, আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় পরিদর্শকদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান, উত্তর কোরিয়ার মানবিক অধিকার পরিস্থিতি- কিছুই এখানে নেই। ঠিক, সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পথে ‘বাস্তব অগ্রগতি’ অর্জিত না হওয়া অবধি উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন ও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অবরোধ বলবৎ থাকছে। কিন্তু বৈঠকটি যে আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এই বাস্তব প্রমাণ করে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, কার্যকর চাপের ফলেই কিম জং-উন আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর সামনে এগোনোর জন্য নমনীয় রাস্তা ধরতে হবে। সন্দেহ নেই, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি বজায় রাখতে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এবার দেশটিকে কিছু ছাড় দেওয়ার জন্য অন্যদের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করবে।
তবে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে এই বৈঠককে চিহ্নিত করতে ট্রাম্পকে বেগ পেতে হবে। কাজটা করার জন্য ট্রাম্প ও তাঁর বাহিনীকে মাথার ঘাম পায়ে ঝরাতে হবে। এ জন্য দরকার হবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাহায্য, যাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেয়াড়া আচরণে ইতিমধ্যে চটিয়ে রেখেছেন। কাজেই বৈঠক-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়া সম্পর্ক তথা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে এখনো যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। এই বৈঠকের চূড়ান্ত ফল কোনদিকে যাবে সেটিই এখন বিশ্ববাসী দেখতে চায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।