বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের প্রেসক্রিপশন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অন্য রূপ
গত কয়েক দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকার কর্তৃক আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটের বিরোধিতা করে যে আন্দোলন শুরু করেছে তা থামবে না। থামার উপায়ও নেই। আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ এক ভিন্ন রূপ।
এই আন্দোলন ক্রমেই বড় হবে, হতে থাকবে, কারণ সরকার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের যে প্রেসক্রিপশন ফলো করে এই পদ্ধতিটি চালু করেছে সেই প্রেসক্রিপশন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে এই ভ্যাটকে সামনে আরো বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই সরকারের হাতে।
সাময়িকভাবে সরকার হয়তো পিছু হটবে, বাধ্য হবে। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক মতবিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘সবার সুবিধার জন্যই সারা বিশ্বের সঙ্গে মিল রেখে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটের ক্ষেত্রে একটি স্তর চালু থাকবে। বিভিন্ন দেশে ভ্যাটের হার ভিন্ন হলেও একটি স্তর থাকে। দেশে সব স্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
গত বৃহস্পতিবার এনবিআর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে এনবিআর বলেছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দেবেন না। মূসক দেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।’
তাহলে একটু জানা যাক ভ্যাট আসলে কী জিনিস? মূসক আইন অনুযায়ী- মূল্য সংযোজন কর (ইংরেজি : Value Added Tax বা VAT), সংক্ষেপে মূসক, বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি আধুনিক কর যা যেকোনো ব্যবসায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট মূল্য সংযোজনের ওপর আরোপ করা হয়ে থাকে। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানি, দেশাভ্যন্তরে সেবা বা পরিষেবার উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মূল্য রপ্তানি করারোপযোগ্য। এই কর উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে কেবল পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। মূসক আরোপের মাধ্যমে আবগারি শুল্ক, বিক্রয় কর ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা দূর হয়েছে।
তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াচ্ছে এই শিক্ষা একটি পণ্যের নাম, যা আমরা ভোগ করে থাকি। কিন্তু সংবিধান কী বলে? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র-সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
সংবিধান শিক্ষাকে পণ্য বলেনি। সুতরাং এই ভ্যাট আদায় অসাংবিধানিক। যেহেতু বর্তমানে রাষ্ট্রের কাছে এর মূল নীতির চেয়ে ব্যবসা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেহেতু সংবিধানের এই অংশটুকু সংশোধনের দাবি রাখে। একই সঙ্গে পাল্টাতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনও। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৪৪ ধারার সাত উপধারায় বলা আছে, ‘কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না।’ সুতরাং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। সেখানে কোনো পণ্যও বিক্রি করা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সাধারণত কোনো ট্রাস্ট ভ্যাটের আওতায় থাকে না। তারপরও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ট্যাক্স না বসিয়ে ভ্যাট বসানো হলো?
এর কারণ ওই যে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। আইএমএফ সরকারকে বাজেট-সহায়তা হিসেবে এক বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে সেখানে একটি শর্ত জুড়ে সকল খাতে দিয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের। সরকার ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ভ্যাট আইন কার্যকর করার মধ্যদিয়ে এই শর্তটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে।
অপরদিকে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্র রয়েছে। সেখানে চার ধাপে এই বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চার পর্বের প্রথম ধাপগুলো হলো প্রাথমিক পর্ব ২০০৬-২০০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-২০১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-২০১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২০২৬।
এই কৌশলপত্রের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার পুরোটাই প্রায় দ্বিগুণ দামে অধিক দামে ক্রয় করার কোনো বিকল্প থাকবে না।
এই কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে ধীরে ধীরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সেবা খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সে পথেই হাঁটছে সরকার।
এবার আবার সাম্প্রতিক ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে ফিরে আসি। শিক্ষার ওপর এই ভ্যাট বসানোটা কেবলমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়। এই সমস্যা সকল শিক্ষার্থীর। এই ধারণাটি এরই মধ্যে বিভিন্নজন উপলব্ধি করতে শুরু করলেও আন্দোলনকে বিভক্ত করতে প্রাইভেট-পাবলিক দেয়াল টানতে একটি গ্রুপ যে সক্রিয়, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই টের পাওয়া যাচ্ছে। তবু যে স্লোগানটি এই আন্দোলন জন্ম দিয়েছে ‘ভ্যাট দিব না, গুলি কর’ সেটার পর আসলে আন্দোলনের সংগ্রামী রূপ দেখতে আর কিছু বাদ থাকে না। অপেক্ষা করতে হয় না।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী