প্রশ্নপত্র ফাঁস
জাতির সব সম্ভাবনা কি আতুড় ঘরেই মারা যাবে?
গত শুক্রবার দেশের সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে পরীক্ষায় সরকারি ২২টি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ ও ৮টি ডেন্টাল ইউনিটে মোট তিন হাজার ৭৪৪টি আসন রয়েছে। আর ৬৫টি বেসরকারি মেডিকেল ও ২৪টি ডেন্টাল কলেজে আসন রয়েছে ছয় হাজার ৩৫৫টি। এ পরীক্ষায় অংশ নেয় ৮৪ হাজার ৭৮৪ জন ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একের পর এক পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। ফাঁস হচ্ছে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও। প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা কিছুতেই নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আগারগাঁও অবস্থিত ইউজিসির কার্যালয়ে ওমর সিরাজসহ তিনজনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। আর তার পরই ওমর সিরাজ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে দাবি করেছে র্যাব। যিনি তার কক্ষে বসানো একটি অত্যাধুনিক ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। যে ডিভাইসটি চীন থেকে আনা হয়েছে। এ ছাড়া অতি ক্ষুদ্র হেড ফোনের মাধ্যমেও যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। যার মাধ্যমে পরীক্ষার্থী ঠিকই পরীক্ষার কক্ষ থেকে স্পষ্ট শুনতে পারবেন প্রশ্নের উত্তর।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সিরাজ জানিয়েছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রের সঙ্গে অসাধু উপায় ও জালিয়াতি করে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র সরবরাহ করে আসছিলেন। মূলত তিন ধাপে জালিয়াতি করে থাকেন তিনি। প্রথম ধাপে বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় তাঁর আগে বাছাইকৃত একটি গ্রুপকে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রেরণ করা এবং এই গ্রুপের কাজ হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কৌশলে হল থেকে বের করে অপেক্ষমাণ অপর একটি গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা।
দ্বিতীয় ধাপে প্রশ্নপত্র সংগ্রাহক গ্রুপটি প্রশ্নপত্রটি দ্রুত সমাধান করে সিরাজের কাছে সরবরাহ করে। সর্বশেষ ধাপে সিরাজসহ আরো কিছু সহযোগীর সহায়তায় আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের মাঝে অত্যন্ত সুকৌশলে উন্নত প্রযুক্তির ডিভাইসে মাধ্যমে উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয়।
শুধু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়, সরকারিসহ প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, জালিয়াতি ও কক্ষে পরীক্ষার্থীদের সুবিধা দেওয়ার মতো সিট প্লানের কাজ করেন ইউজিসির সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ। গত ৫ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পেছনে কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে সংস্থাটি অভিযোগ করে। প্রতিবেদনে সরকারি-বেসরকারি কিছু অসাধু ব্যক্তিদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ জমজমাট বাণিজ্য চলে বলে জানানো হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন মিথ্যা বলে দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বাস্তবে মন্ত্রীর সেই বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইউজিসির সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ।
আগে যেমন, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র কঠিন হবে নাকি সহজ হবে- এটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম টেনশন কাজ করত। পরীক্ষার আগের রাতে সারারাত সিলেবাসের পড়াগুলো রিভিশন দেওয়ার জন্য চেয়ার-টেবিলে বসে সময়ের সাথে রীতিমতো ছাত্রদের যুদ্ধ করতে হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও ভিন্ন। ছাত্র ও অভিভাবকের ব্যস্ততা ও টেনশন থাকে আগের চেয়েও অনেক বেশি, কিন্তু তা পড়াশোনা নিয়ে নয় বরং প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে কি না তা নিয়ে। এতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি জাতি হারাচ্ছে প্রকৃত মেধাবীকে।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রশ্ন ফাঁসের গুরুতর অভিযোগকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ কখনই সরাসরি স্বীকার করেননি। গত বছর এ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রশ্ন ফাঁসকারীদের শনাক্ত করতে না পারলেও প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৭ দফা সুপারিশ করেছিল। যার মধ্যে ছিল- প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বাছাই প্রক্রিয়া আধুনিক করা, বিজিপ্রেসের নিরাপত্তা জোরদার করা, গোপন ছাপার ব্যবস্থা আধুনিক করা, চিহ্নিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া, সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা। দুর্ভাগ্যজনক হলো এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক দেখা যায়নি। এ বিষয়ে কেন এত অনীহা তার উত্তর আমাদের জানা নেই।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব মহলের জিজ্ঞাসা-প্রশ্নপত্র ফাঁসের কি কোনো সমাধান হবে না? যারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত তাদের কি শাস্তি হবে না? নাকি আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণেই তারা ছাড় পেয়ে যাবে? এভাবে একটি রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। চোখ বুঁজে দায় এড়িয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রলয়ের দিকে ঠেলে না দিয়ে কর্তৃপক্ষকে এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। গোয়েন্দা বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে ফাঁসকারী চক্রকে শনাক্ত করতে হবে এবং এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সচেতন সমাজ সবাইকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নতুবা জাতির সব সম্ভাবনা আতুড় ঘরেই মারা যাবে।
লেখক : সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।