নির্বাচন
ভোটে গণমাধ্যম কতটা স্বচ্ছন্দে?
ভোটাররা আছেন ভোটের অপেক্ষায়। একদিনের রাজা হবার আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠতে উম্মুখ ভোটাররা। উৎসবের সেই রঙে রাঙা গণমাধ্যমকর্মীরাও। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ বছরের মেয়াদে দেশে নানা পর্যায়ের ভোট হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনের ব্যপ্তি, আকার যত ছোটই হোক না কেন, ওই ভোট উৎসবে যোগ দিতে পারা যেকোনো গণমাধ্যমকর্মীর জন্যই আনন্দের, অহঙ্কারের এবং শিক্ষণীয়ও বটে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হয়তো অনেক ইভেন্ট, বিট কভার করেছেন তার পেশাগত জীবনে। কিন্তু নির্বাচন কভার করার সুযোগ পাননি, তিনি নিজেকে একটু পেছনে পড়ে থাকা কর্মীই মনে করে থাকেন। এই পেছনে পড়ে থাকার কারণও আছে। ভোটে রাজনৈতিক নানা প্রকার মেরুকরণ হয়। রাজনীতিক দলগুলোর শক্তি, সুদূরপ্রসারী ভাবনা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে তাদের আদর্শিক অবস্থান, সহরাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে আদর্শের ছাড় বা বেচাকেনা। এগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে ভোটের বাজারে। সঙ্গে যোগ হয় ভোটারদের জন্য নিবেদিত তাদের ইশতেহার।
বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকুক কিংবা না থাকুক ইশতেহার থেকে এতটুকু অনুমান করা যায় যে, দলটি আসলে কতটুকু কল্যাণ রাষ্ট্রমনা। সাংবাদিকরা সবচেয়ে বড় সুযোগ পান সাধারণ মানুষ বা ভোটারের প্রতিক্রিয়া জানার। ক্ষমতাসীন দল বা দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষরা কী ভাবছেন, তাদের কর্মসূচিকে কোনো কৌণিক অবস্থান থেকে দেখছেন, এই ধারণাগুলো ভোটের মাঠ থেকে সহজেই কুড়িয়ে নিতে পারেন গণমাধ্যমকর্মী। ভোট পরবর্তী সময়ে তিনি যে বিষয়েই কাজ করেন না কেন, সেখানে রাজনৈতিক দলের জনভাবনা এবং জনগণের রাজনীতি ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত এবং চিন্তনের কাজ করে। এই বাস্তবতাতেই প্রতিবারের মতো এবারও ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু ভোটের দিন গণমাধ্যমকর্মীরা কতটা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারে এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। উদ্বেগের কারণ—নির্বাচন কমিশন সচিবালয় রিটার্নিং অফিসারদের কাছে যে নয়টি শর্ত পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে- প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া কোনো ভোটকক্ষে প্রবেশ করা যাবে না; একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না; ১০ মিনিটের বেশি কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবে না; ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারবে না এবং ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।
এই মুহূর্তে মাঠের বাস্তবতা হলো – সাংবাদিকদের ভিড় সম্ভাব্য প্রার্থী, কর্মী এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের চেয়েও বেশি। কারণ মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়াও দেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং টিভির বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠে ঘাটে অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য। গত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলোতে তাদের বেপরোয়া আচরণ নিজেই দেখেছি। এই অনলাইন পোর্টালগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয়। বেশিরভাগই এক বা দুই ব্যক্তি সর্বস্ব। আছে অজানা টেলিভিশন। ইউটিউব চ্যানেলও চলে যায় নির্বাচন কভার করতে। ইউটিউব, ফেসবুক লাইভ দিতে ভিড় করে ভোটকেন্দ্রে। রাজধানী কেন্দ্রিক অনেক দেয়াল ও পাতালে থাকা গণমাধ্যমও ভোটের দিন জেগে উঠে। সঙ্গে আছে প্রকৃত পেশাদার মূলধারার পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন এবং অনলাইন ওয়েব পোর্টাল।
স্থানীয় পর্যায়েও কয়েকটি স্বীকৃত পত্রিকা ও ওয়েব পোর্টাল আছে। এরা সবাই কিন্তু ভোট উৎসবে বের হবে বেশ সেজেগুঁজেই। প্রতি কেন্দ্রেই হানা দেবে তারা। নিজেদের মতো করে ভোটের খবর বলবে। দায়িত্বশীল গণমাধ্যম বিচার, বিশ্লেষণ করে ভোট গ্রহণের তথ্য দেবে। তাদের সম্পাদকীয় নীতি যেমন আছে, তেমনি সার্বক্ষণিক তাদের পরিবেশিত খবর সম্পাদনার জন্য কর্মী বাহিনী তৎপর থাকবে। কিন্তু দেয়াল, পাতাল ও ব্যক্তিনির্ভর গণমাধ্যম পরিবেশিত খবর ছাঁকার উপায় কী? তারা সবাই যদি একবার করে প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চায় , তাহলে প্রিজাইডিং অফিসার তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারবেন না। সকলে ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি খবর পরিবেশন ভোটারদের বিরক্তির কারণ হতে পারে। এই বাস্তবতাগুলো দেখলে মনে হতে পারে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া শর্ত যথাযথ। কিন্তু তা মনে করা যাবে না এজন্য যে— আগাছা নির্মূল করতে গিয়ে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলো যথাযথ ভাবে ভোট পর্যবেক্ষণ এবং কভারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
সমস্যার সমাধান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাছেই আছে। তারা ভোটগ্রহণের দিনের জন্য অনুমতিপত্র দেয়। দেশে কোন পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন পাঠক, দর্শক প্রিয়তা বা গণমাধ্যম পেয়েছে, তা তাদের জানা। বা সাধারণের মধ্যেও এ বিষয়ে ধারণা আছে। শুধু ডিএফপি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়াই একমাত্র যোগ্যতা হওয়া ঠিক হবে না। অনুমোদনের তালিকায় দেয়াল ও পাতালের গণমাধ্যমও আছে। তাই অনুমোদন পরবর্তী পারফরমেন্স এখানে গুরুত্ব পাওয়া উচিত। গণমাধ্যম সম্পাদক ও প্রধানদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন মতবিনিময় করেও তালিকাটি প্রস্তত করতে পারে। সময় কম, তবুও উদ্যোগে আন্তরিকতা থাকলে সম্পন্ন করা সম্ভব। এতে অন্তত ভিড় কমানো যাবে। সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তা টেলিভিশনগুলোকে ভোটকেন্দ্র বণ্টন করে দিতে পারেন। একই কেন্দ্রে সকলের ভিড় করার প্রয়োজন হবে না। যদি না বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। পরামর্শ থাকতে পারে, অযথা ভোটকেন্দ্রে বেশি সময় অবস্থান না করার। প্রিজাইডিং অফিসারদের ভোটগ্রহণের তিন ধাপে কথা বলার সুযোগ দেওয়া যায়। শুরুর অবস্থা, দুপুর ২টার মধ্য পরিস্থিতি এবং শেষে ভোটগ্রহণের হার নিয়ে তারা কথা বলতে পারেন।
নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এ কথা মনে রাখতে হবে একটি নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তার পরিমাপ নির্ভর করে ওই ভোটে গণমাধ্যম কত স্বচ্ছন্দে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিল তার উপর।
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি