অভিমত
টেলিভিশন নিয়ে আমরা কি যাব বোকার নরকে?
ব-দ্বীপের দর্শকের চোখ সীমানা পেরিয়ে গেছে। এ নিয়ে রাখঢাক আবার সরল স্বীকারোক্তিও ছিল। দর্শকের মন-চোখ ভজে না দেশীয় নির্মাণে। বিদেশি নির্মাণের গল্প, উপস্থাপন এবং আয়োজন সবই কেমন ঝলমল করে। একটা সচ্ছলতা ভাব সবখানে। বিত্তের ঝলকও আছে। আমদর্শক তো সেই বিত্তেরই স্বপ্ন দেখে। উল্টোদিকে দেশীয় চ্যানেলের গল্প, উপস্থাপন এবং আয়োজনে গরিবি হাল। দুঃখ-কষ্টে জীবন যাদের, তারা আর কত কৃপণতা দেখবে। পাশাপাশি চমকে দেওয়ার মতোও গল্প কম। দর্শক ধরে রাখার মুন্সিয়ানা নেই। তাই দর্শকও দেশীয় নির্মাণ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল, বিদেশি চ্যানেল, বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের অনুকরণে ধারাবাহিক এবং রিয়েলিটি শো আয়োজনের। সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। দর্শক চোখ ফেরায়নি।
দর্শক চোখ ফেরায়নি বলেই দেশীয় বিজ্ঞাপনেরও বিদেশযাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিদেশি চ্যানেল, বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। বাংলাদেশের চ্যানেলের জন্য তাদের বরাদ্দ কমতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই আয় কমে যায় স্থানীয় চ্যানেলগুলোর। প্রতিবাদ, আপত্তি ওঠে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধের। নানা উদ্যোগ নির্দেশনার পরেও গত প্রায় এক দশকে বন্ধ করা যায়নি ওই প্রবণতা। অবশেষে তথ্য মন্ত্রণালয় কঠোর হলো। নির্দেশনা দেওয়া হলো বিজ্ঞাপন বন্ধের। বিদেশি চ্যানেল বিপণন বা বিতরণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু দেখা গেল জি নেটওয়ার্কের সকল চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আমরা চ্যানেল বন্ধের কথা বলিনি। কাণ্ডটি ঘটিয়েছে কেবল অপারেটররা। কেবল অপারেটরদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, যদি ভারতীয় বা বিদেশি চ্যানেল বন্ধ থাকে, তাহলে গ্রাহকরা কেবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে থাকবেন। তাতে কেবল অপারেটরদের নিয়ে যে একটি বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান খাত তৈরি হয়েছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে তারা এই কথাটিও প্রচ্ছন্নভাবে বলে দিলেন যে, দেশীয় চ্যানেলের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ নেই। দেশীয় চ্যানেলকে নির্ভর করে এই খাত টিকে থাকবে না। তর্কে বহুদূর যাওয়ার সুযোগ আছে। আজ কেবল অপারেটররা পূর্বাভাস দেখাচ্ছেন। সেখানে তাদের জন্যও কিছু আগাম বার্তা আছে—দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক আইপি টিভির প্রসার শুরু হয়েছে। অনেকে স্যাটেলাইট চ্যানেলও ইন্টারনেট বা অ্যাপসের মাধ্যমে দেখতে শুরু করেছেন। এই অভ্যাস দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। বছর দুয়েকের মধ্যে শহর ডিঙিয়ে গ্রামেও আইপি টিভির ভোক্তা বাড়বে। এ বাস্তবতায় কেবল অপারেটরদের নতুন প্রযুক্তির প্রভাবের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিমগ্ন হওয়াই উচিত। কারণ কেবল নির্ভরতায় গ্রাহকদের আটকে রাখার মুরোদ কারোরই থাকছে না। না টেলিভিশন, না কেবল অপারেটর।
কোনো চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে সমাধান খোঁজা বা সমাধানে পৌঁছার দিন ফুরিয়েছে আগেই। গ্রাহক তার মতো করে সহজেই এখন বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারে। সুতরাং আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের অনুষ্ঠানকে পুষ্টিকর এবং আকর্ষণীয় না করতে পারছেন, ততক্ষণ আকাশ বন্ধ রেখেও ফায়দা হবে না। আগের দিন নেই যে বাধ্য গ্রাহকের মতো সবাই বিটিভি এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলে চোখ রেখে দেবে। আমাদের এখানে যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এসেছে তাদের কেউ বাজার জরিপ করে মাঠে নেমেছে কি না সন্দেহ। করপোরেট গোষ্ঠীর চাহিদা, রাজনৈতিক চাহিদার ফল টেলিভিশন বিস্ফোরণ। ফলে আয়ের হিসাব না করেই তারা ব্যয় করতে শুরু করেছিলেন। এখন মাঝপথে বা দুই পা ফেলেই বুঝতে পারছেন ‘টেলিভিশন দৈত্য’কে বাঁচিয়ে রাখা কত কষ্টের। ফলে মানবসম্পদ ছাঁটাইয়ের পাশপাশি অনুষ্ঠান নির্মাণ বাজেটও কমিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো বন্ধই করে দিয়েছে। তাদের শুধু বিজ্ঞাপনের ক্ষুধা। কিন্তু দর্শকের মন ও চোখের ক্ষুধা মেটানোর তাগিদ নেই।
তাঁরা এ কথা ভাবছেন না যে, দর্শক যেখানে নেই, সেখানে বিজ্ঞাপন প্রত্যাশা করাটাও বোকামি। এই বোকার রাজ্যে বসে আমাদের টেলিভিশনের সুদিনের স্বপ্ন দেখব? আর একটু বলে রাখি, আইপি টিভি নিয়েও যাঁরা স্বপ্ন বুনছেন, তাঁদেরও মস্তিষ্কে এই চিন্তা সক্রিয় রাখতে হবে যে তার, তাদের ভোক্তা দুনিয়া জোড়া। সুতরাং আইপি টিভি নিয়েও চড়ুইভাতি খেলার সুযোগ নেই। সেখানকার জন্য তৈরি পণ্যও হতে হবে গুণগত মানের। না হলে আবার আমরা নিক্ষেপিত হওয়ার বোকার নরকে!
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি।