গণমাধ্যম
পাল্টে যাচ্ছে সাংবাদিকতার ধরন ও ধারণা
স্বাধীনতার ৪৪ বছরের বাঁকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিকাশ। আর মাত্র ছয় বছর পরই তা পৌঁছবে অর্ধশত বছরে, সুবর্ণজয়ন্তীতে। সাংবাদিকতাসহ গণমাধ্যমে কাজ করা বাংলাদেশে এখন একটি পরিপূর্ণ পেশা। লক্ষ্য-অঙ্গীকারের পাশাপাশি রুটি-রুজি, কর্মসংস্থানের বিশাল ক্ষেত্র। তা আর নেহাত শখের বশ মেটানো বা শৌখিনতার পর্যায়ে নেই। স্বেচ্ছাশ্রমে খাটার দিনও শেষ। জেনে-বুঝে-শুনে জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রতিবছর সাংবাদিকতা ছাড়াও গণমাধ্যমে বিভিন্ন পদে অভিষেক ঘটছে শত শত তারুণের। এ ছাড়া কেবল সংবাদপত্রই এখন তাদের কর্মক্ষেত্র নয়। দুই ডজনের বেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বেশ কটি এফএম রেডিও ছাড়াও যোগ হয়েছে নতুন নতুন অনলাইন মাধ্যম। অন্যান্য গণমাধ্যমের চেয়ে আগেভাগে খবর দেওয়ায় মানুষ একাধিক অনলাইন পত্রিকা পড়ছে। কয়েকটি অনলাইনে স্টিল ছবির সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে অডিও, ভিডিও। চলছে বেশ কটি কমিউনিটি রেডিও-ও। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, দেশে অনুমোদন রয়েছে ৪৪টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, এক হাজার ১৮৭টি দৈনিক পত্রিকা, শতের ওপর অনলাইন পত্রিকার।
সময়ের চাহিদা ও দ্রুত উৎকর্ষের সুবাদে প্রিন্ট ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার ধরন- ধারা-ধারণাও পাল্টে গেছে। এ দুই মাধ্যমের ব্যবধান অনেক কমে গেছে। পুঁথিগত ধারণার সঙ্গে মুদ্রণ বা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ব্রডকাস্ট মিডিয়া, সম্প্রচার মাধ্যম ইত্যাদি শ্রেণিবিন্যাস আর টিকছে না। টিভি, রেডিও, অনলাইনগুলো ইলেকট্রনিক জার্নালিজমের পর্যায়েই পড়ছে। আবার বৈশিষ্ট্য ও কাজের পরিধি বিচারে সংবাদপত্রগুলোকেও এখন একবাক্যে প্রিন্ট মিডিয়া নামে সীমাবদ্ধ করা যাচ্ছে না। মুদ্রণ সাংবাদিকদেরও এখন সারাক্ষণ ইলেকট্রনিকবান্ধব হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ব্লগসহ নানা ইলেকট্রনিক ফাংশনে সম্পৃক্ত তারাও। স্বাধীনতার আগে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ দেওয়া হতো শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা-ও ডিপ্লোমা এবং নাইট কোর্স। সেটি এখন আর ডিপ্লোমা বা কোর্সের মধ্যে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের নাম পাল্টে হয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। রাতের ক্লাস চলে আসে দিনে। এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্সটি হয় তিন বছরের অনার্স। পরে করা হয় চার বছর। সঙ্গে মাস্টার্সও। এর পরিধি এখন আরো বিস্তৃত। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় সাবজেক্ট। প্রতিবছর প্রাইভেট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা যোগ দিচ্ছে গণমাধ্যমে। মানুষকে দিন-দুনিয়া সম্পর্কে অবহিত রাখার এ অঙ্গীকারে ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে মেয়েরাও। দেশের গণমাধ্যমে নারীর অবস্থান, বিশেষ করে তাদের পদ-পদবি, আয়, কর্মদক্ষতা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে। সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোতেও তাদের নেতৃত্ব বাড়ছে। এরই মাধ্যমে গণমাধ্যমে শতকরা ২৫ ভাগ নারী নিয়োগের পক্ষে ব্যক্তিগত মত জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী।
স্বাধীনতার পর আশির দশকে দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। নব্বইয়ের দশকে এ সংখ্যা যৎসামান্য বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকতায় আসে একটি আকস্মিক বিকাশ। বিপ্লবও বলা যায়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একটি বড় পরিবর্তন আসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মুদ্রণ এবং প্রকাশনা আইন সংশোধন এ সেক্টরে রীতিমতো ঝড় তোলে। এর জেরে জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে আঞ্চলিক পত্রিকার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হাল হিসাবে রাজধানী ঢাকায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত আছে ২৩০টি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। তথ্য বা ঘটনা হিসেবে এটি নজিরবিহীন।
লন্ডনের মতো বড় ও বিখ্যাত শহরে ব্রডশিট ও ট্যাবলয়েড মিলিয়ে পত্রিকার সংখ্যা বিশের বেশি নয়। নিউইয়র্কে রয়েছে মাত্র দুটি নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওয়াশিংটনে আছে মাত্র একটি ওয়াশিংটন পোস্ট। রাজধানীর বাইরে পত্রিকার সংখ্যাগত হিসাবেও বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ছাড়াও কোনো কোনো জেলা শহরে অবস্থাসম্পন্ন একাধিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে। গণমাধ্যমবিষয়ক বেসরকারি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাবে ঢাকার বাইরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এখন কাজ করছেন অন্তত সাত হাজার সাংবাদিক। সব মিলিয়ে ৪৪ বছরে গণমাধ্যম বাংলাদেশে এখন শিল্প পর্যায়ে। শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রির নানা উপাদান ও লক্ষণ এ সেক্টরেও উপস্থিত। শিল্প পরিচালনার জন্য দরকার কাঁচামাল। গণমাধ্যমে কাঁচামাল হচ্ছে সংবাদ। সেই কাঁচামালগুলোকে সম্পাদনাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ করেন সাংবাদিকসহ সংবাদকর্মীরা। সে সঙ্গে বিজ্ঞাপন, বাজারজাতকরণসহ অন্যান্য বিভাগে রয়েছেন আরেক দল কর্মী। ব্যতিক্রমী এ শিল্প সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
সামাজিক বিশাল দায় সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের ওপর। দায়ের সঙ্গে দায়িত্বও। দায়-দায়িত্ব এবং পেশাদারিত্ব এ তিনটির সঙ্গে এসে গেছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। যে কারণে নীতিমালার মধ্যেও আসতে হচ্ছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এর গেজেট হয়েছে। এই নীতিমালাকে দেখা হচ্ছে ইতি-নেতি দুইভাবেই। মানুষকে বৃহত্তর পৃথিবী দেখানো, নতুন দিগন্তে নিয়ে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালা বা দিকনির্দেশনাকে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুভাবে দেখার সুযোগই রয়েছে। নেতিবাচকভাবে বিশ্লেষণকারীদের মতে, এটি আরেকটি কালো দলিল এবং নির্বতনের হাতিয়ার। এই নীতিমালার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে আরো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে দাবি তাদের। অন্যদিকে ইতিবাচক হিসেবে বলা হচ্ছে, নীতিমালার সুবাদে গুরুত্ব ও মর্যাদা বাড়ছে সাংবাদিকসহ গণমাধ্যমের। এ পক্ষটি বলতে চান, এটি জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টদের অবদানের প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক স্বীকৃতি। পলিসি, নীতিমালা বা দিকনির্দেশনার সঙ্গে জবাবদিহির প্রশ্ন জড়িত। সাংবাদিক বা সম্প্রচার কর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনাকে অশোভন, অবমূল্যায়ন বা নিয়ন্ত্রণ মনে করছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে নীতিমালার প্যাঁচে ফেলা অপমানের।
তাঁদের যুক্তি, সাংবাদিকরা সারাক্ষণ নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জবাবদিহির মধ্যেই থাকেন তাঁরা। এর পাল্টা মত হচ্ছে, বেতন স্কেলসহ মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অবস্থানের স্বীকৃতির নিশ্চয়তা মেলে একটি ইউনিফাইড কোড অব কন্ডাক্টে। এতে রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ আইন, বিচার, নির্বাহী বিভাগের মতো সম্প্রচার মাধ্যমেরও মর্যাদা, অধিকার, স্বার্থ রক্ষা হবে। তাই অনেকে বলছেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের গুরুত্ব দাবি করবে, কিন্তু কারো কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না—এটা হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের আলোচনা-সমালোচনা, ইতি-নেতি বিতর্কের মধ্য দিয়ে একটা জায়গা আমরা নিশ্চয়ই পৌঁছাব।
নীতিমালার মূল স্পিরিট সম্প্রচার মাধ্যম বা সাংবাদিকতার বিকাশের উদ্দেশ্যে হলে তা একটা সময় সুফল বয়ে আনবে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবাদ, সাংবাদিক, সাংবাদিকতার ৪৪ বছরের ইতিহাসে তা বারবার দেখা গেছে। গণমাধ্যমের বিশ্ব ইতিহাসও এর উদাহরণ। অপ্রিয় কিন্তু বাস্তব তথ্য হচ্ছে, গণমাধ্যমের পথচলা কখনোই মসৃণ ছিল না। গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে বরাবরই রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। বিশ্বে গণমাধ্যমের জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই একে আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে নিতে সচেষ্ট ক্ষমতাধররা। তা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা নয়, প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যবসাসহ সব ক্ষমতাধরেরই এটা বৈশিষ্ট্য। কোনো ক্ষমতাবানই সমালোচনা সহ্য করতে চায় না, চেষ্টা করে যেন নিজের অপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছে। সে সঙ্গে চায়, নিজের পক্ষে একতরফা প্রচার এবং বিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ক্ষমতায় কমতি মনে করলে এ লক্ষ্যে, এমনকি আইন করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ঘটনাও রয়েছে দেশে দেশে। শুধু আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য নয়, উন্নত বহু রাষ্ট্রেও চলছে এ সংস্কৃতি। সভ্য দুনিয়ার বুনিয়াদ ব্রিটিশরাও এ সংস্কৃতির বাইরে নয়, বরং অত্যন্ত সম্পৃক্ত। আইন করে যুক্তরাজ্যের রাজা, রাজকর্মচারী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ উপস্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ব্রিটিশদের এই অঞ্চল ছাড়ার পর পাকিস্তানের উপনিবেশেও তা বলবৎ থেকেছে। খুব বদলায়নি স্বাধীন বাংলাদেশেও। সময়ে সময়ে আইনের বাইরেও নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা বা অপচেষ্টা হয়েছে। এ বাস্তবতায় সারা দুনিয়ায় এখন সরকার, ব্যবসায় বা আমলাতন্ত্র বা অন্য কোনো শক্তির বন্ধনহীন পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বা গণমাধ্যম পাওয়া দুষ্কর। সে সঙ্গে অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা উৎকর্ষও এসেছে অতি নিয়ন্ত্রণ বা নিবর্তনের উতরানোর মধ্য দিয়েই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে গণমাধ্যমের বিকাশ আরো বেশি হয়েছে। ইতিহাস বলছে, গণমাধ্যমের সূচনাই হয়েছে দায়বদ্ধতা, সীমাবদ্ধতা, পরাধীনতা এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালে রাজা জুলিয়াস সিজারের আমলে সংবাদপত্রের মূল রূপ হাতে লেখা শুরু হয় রাজবেতনে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে। ‘খাস লেখক’ নামের ওই ব্যক্তিরা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শুধু রাজার পক্ষে খবর সংগ্রহ করে সেগুলো লিখতেন। খাস লেখক মানে আজকের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক বা রিপোর্টার। এগারো শতাব্দীর পর মৌখিক তথ্য প্রচারকাজে নিয়োজিতদের বলা হতো নগর ঘোষক। ঘণ্টা বাজিয়ে লোকজন জড়ো করে সংবাদ পাঠের স্টাইলে রাজা-উজিরদের প্রশংসাসুলভ খবর প্রচার করতেন ওই নগর ঘোষকরা। ধারণাগতভাবে তারা আজকের নিউজপ্রেজেন্টার বা রিপোর্টারের মতো।
সংবাদপত্রের বিকাশকে ক্ষমতাধররা বরাবরই ক্ষতিকারক মনে করে দমন বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। আবার এ দমন-নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলার জেরেই যুগে যুগে এসেছে গণমাধ্যমের বিকাশ। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর সংবাদপত্র আধুনিক হলেও রাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেনি। একদিকে চলেছে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, আরেকদিকে হয়েছে বিকাশ। সম্রাটদের বাণীসংবলিত গেজেট বা গেজেটা নামে সংবাদপত্রটির প্রকাশনা বন্ধের উপক্রম হয় কয়েকবার। পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ থেকে ১৮৫ সাল পর্যন্ত মৌর্য বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় খবর প্রচারকারীদের ‘ওভারশিয়ার’ নামে সম্মানসূচক পদ দেওয়া হলেও নিয়ন্ত্রণ ছিল শতভাগ। মৌর্য বংশের শেষ রাজা অশোকের সময় ওভারশিয়ারদের নাম পাল্টে করা হয় প্রতিভেদকা। এই প্রতিভেদকা শব্দ থেকেই পরে প্রতিবেদক শব্দটির উৎপত্তি বলে মনে করেন সংবাদ বিশ্লেষকরা। মোগল শাসক সম্রাট আকবরের সময় ওয়াকিয়া নবিশ, খুপিয়া নবিশ, সাভানি নিগার—তিন ধরনের প্রতিবেদক বা সাংবাদিক রাজা-উজির ও তাদের পরিবারের প্রশংসা প্রচার করতেন। সে সঙ্গে বিরুদ্ধাচারকারীদের ব্যাপারে প্রজাদের সতর্ক করার পাশাপাশি সাম্রাজ্য বিস্তার ও রক্ষায় ভূমিকা রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। এসব লেখক-প্রচারকারক রাজমহলে খুব সম্মানিত প্রভাবশালী ছিলেন। আবার প্রশংসায় কমতি বা ঘাটতি হলে কঠোর শাস্তিও ভোগ করতে হতো। গণমাধ্যমের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭০২ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ইংল্যান্ডের প্রথম দৈনিক ‘ডেইলি কুরান্ট’ পত্রিকায় সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আনার চেষ্টা চলে। এতে রাজমাধ্যমকে কিছুটা গণমাধ্যমে রূপ দেওয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রজাদের কিছু খবর প্রচার করা হয়। তা মাত্রায় কিছুটা বেশি মনে হলেই রাজদণ্ড নেমে আসত। কখনো ছাপাখানা সিলগালা করা হতো। কিছু ছাপার আগে তা সরকারের বিশেষ বিভাগকে দেখিয়ে নেওয়ার বিধান চালু করার ইতিহাসও পাওয়া যায়।
রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় ১৫৫৮-১৬০৩ এক ছাপাখানা মালিকের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বই এ ধারার বাইরে নয়। নানাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনকে কম বললে সত্যকে অস্বীকার করা হবে। এ অর্জন এগোবে গণমাধ্যম কতটুকু গণমানুষের, কতটুকু ক্ষমতাসীনদের আর কতটুকুই বা স্বতন্ত্র-স্বাধীন—এ বিতর্ক ও প্রশ্নের মধ্য দিয়েই। পাশাপাশি আলামতই বলে দিচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির আরো ব্যাপকতা আসবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে। মানুষের তথ্য চাহিদায় রকমফের আসছে। মানুষ পাঠের সঙ্গে দেখতে-শুনতেও চায়। তাই কাউকে এখন শুধু পাঠক বলে সম্বোধনের অবস্থা নেই। যিনি পাঠক, তিনিই দর্শক। আবার শ্রোতাও। এককথায় অডিয়েন্স। এই অডিয়েন্সের চাহিদার জোগান দিতে প্রতিযোগিতায় চলছে পত্রিকা, টিভি, রেডিও, অনলাইনসহ সব সম্প্রচার মাধ্যমে। এ প্রতিযোগিতায় বৈচিত্র্য, নতুনত্ব আনতে বাধ্য হচ্ছে সবাই। অনলাইনগুলোর বেশ কটির মধ্যে পঠন, শ্রবণ, দর্শন—তিন মাত্রার চাহিদা জোগান দেওয়ার চেষ্টা বেশ লক্ষ করার মতো। তা সারা বিশ্বেই বেশি কঠিন বাস্তবতায় ফেলেছে সংবাদপত্রকে। মার্কিন এক লেখক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ২০৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদপত্রের শেষ কপিটি বিক্রি হবে। আংশিক বাস্তবতার আলোকেই তাঁর এ উদ্বেগ।
অনলাইন, রেডিও, টিভি মাধ্যমের দাপটে সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জ পড়েছে, এ সত্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আরেক সত্য। তা হচ্ছে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে প্রচারসংখ্যাও। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবাস সংস্করণের চিন্তাও করছে কয়েকটি দৈনিক। পাঠকের তথ্যক্ষুধা মেটানোর প্রতিযোগিতার দৌড়ে কয়েকটি পত্রিকা উপাদান, আঙ্গিক সবকিছুতে বৈচিত্র্য, পরিবর্তন, পরিবর্ধন যোগ করছে প্রতিনিয়ত। বলতে গেলে এ ক্ষেত্রে এক ধরনের নীরব কিংবা প্রকাশ্য প্রতিযোগিতাও আছে। কারা কোন খবরটি কত তাড়াতাড়ি পাঠকের কাছে কত নির্ভুলভাবে পৌঁছাতে পারে—এই প্রতিযোগিতার তাড়নায় রেডিও, টিভি, পত্রিকা, অনলাইনসহ গণমাধ্যমগুলো। এ প্রতিযোগিতা পেশাদারিত্ব ও বিকাশেরই অংশ। আর এই পেশাদারিত্ব হচ্ছে পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।