তখন পারভিন, এখন দীপিকা
শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলামিস্ট। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি বলিউডের তারকারা নিজেদের মানসিক অবস্থার কথা খোলামেলাভাবেই বলছেন, যা কয়েক বছর আগেও ছিল কল্পনার অতীত। কেন এমন পরিবর্তন? সেটারই তত্ত্ব-তালাশ করেছেন শোভা দে। গত ২০ জানুয়ারি এনডিটিভির অনলাইনে প্রকাশিত লেখাটি ভাষান্তর করেছেন সামি আল মেহেদী।
পারভিন ববি। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক বলিউড নায়িকা। এই এগিয়ে থাকাটাই বোধহয় তাঁর মানসিক দুরবস্থার জন্য দায়ী। তার মতো অপূর্ব সুন্দরীকে যখন এমন দুঃখজনকভাবে, অকালে, একলা মরতে হয় তখন সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। ২২ জানুয়ারি, ২০০৫! অগণিত ভক্ত আর সহকর্মী জানতেও পারলেন না, মাত্র ৫৬ বছর বয়সে কেন এমন মৃত্যু! হয় তো তাঁর এক সময়ের সঙ্গী, মহেশ ভাটই জেনে থাকবেন কী রকম মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন ববি। ওই অবস্থা থেকে বের করে আনতে মহেশ ভাটও তখন তাঁর কাছে ছিলেন না। জুহুর অ্যাপার্টমেন্টে নিঃসঙ্গ, একাকী মৃত্যুবরণ করেন পারভিন ববি।
সেই যুগে বলিউড আর গণমাধ্যম তাঁকে ‘পাগল’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছিল। মানুষও তাতে দিব্যি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছে, বলেছে ‘ও তো পাগল হয়ে গেছে’! বেচারি পারভিন ববি! তিনি ‘পাগল’ ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কঠিন রকম অসুস্থ। ধারণা করা হয়, তিনি বহুদিন ধরে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এ অসুস্থতার মাত্রা ছিল তীব্র, কিন্তু তা নিয়ে তেমন কেউই মাথা ঘামায়নি! কেউ একে ‘ডিপ্রেশন’ বলেছেন, কেউ বা তাঁকে ‘স্কিৎজোফ্রেনিক’ আখ্যা দিয়েছেন। মনের মাঝে গেড়ে বসা অসুস্থতার বিরুদ্ধে একলাই লড়ে গেছেন পারভিন। এমনকি যারা তাঁকে ‘ভালোবাসত’ বলে দাবি করত, তাঁরাও তাঁকে ত্যাগ করেছিল।
আজকের গল্পটা একেবারেই আলাদা। বলিউডে মানসিক স্বাস্থ্য সমাচার-সংক্রান্ত এই নতুন চিত্রনাট্যের রচয়িতা দুই আকর্ষণীয় এবং সফল অভিনেত্রী। এ কথাটা বলতে গিয়ে আমি জিভে কামড় দিতে প্রস্তুত, কিন্তু দীপিকা পাড়ুকোন আর আনুশকা শর্মার ক্ষেত্রে, আমার বিশ্বাস, এই সাম্প্রতিক ‘মানসিক অসুস্থতা’বিষয়ক স্বীকারোক্তির পেছনে কাজ করছে কোনো পরিকল্পনা!
প্রথম সারির দুই নায়িকা, একই সময়ে, একই ধরনের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলছেন, বিষয়টি বিস্ময় জাগানোর মতোই ! প্রথমে আনুশকা সবার সামনে জানালেন নিজের ‘মানসিক’ উদ্বেগজনিত সমস্যার কথা। এর ঠিক এক সপ্তাহর মাথায় দীপিকাও সবাইকে জানালেন তাঁর ‘হতাশা’ সংক্রান্ত ভোগান্তির কথা! এটা কি স্রেফ কাকতালীয় ঘটনা?
অবশ্য দীপিকার বয়ানেই এ বিষয়ে আভাস পাওয়া গেছে। নিজের মানসিক অবস্থা বর্ণনা শেষে দীপিকা জুড়ে দেন, ভারতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তিনি বেশ ‘বড়সড়’ কিছু করছেন। মনমেজাজের ‘এই ভালো, এই খারাপ’ আর আবেগের অবিরত ‘ওঠানামা’ নিয়ে আনুশকাও আর কিছু বলেননি। তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াল? এই দুই সুন্দরী কি কয়েকদিন বাদেই কোনো বড়সড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা দেবেন?
এতে যাই মনে হোক না কেন, আনুশকা-দীপিকাদের এ ধরনের ‘তারকামার্কা স্বীকারোক্তি’র কারণে স্বাভাবিকভাবেই সাড়া জাগিয়েছে ভারতে। তারকাদের কথায় এতদিন তেমন গুরুত্ব না দিলেও এখন ভক্তরা আনুশকা ও দীপিকার কথায় রীতিমতো পুলকিত এবং এ জন্য ‘সাহসী’ বলে হাততালিও দিচ্ছেন। এক বিশাল ট্যাবু শেষমেশ ভাঙল, তাও কি না বলিউডের দুই শীর্ষ তারকার মাধ্যমে! পুরো ভারতে তাঁদের উদ্দেশ্য জয়ধ্বনি হচ্ছে- ‘সাবাস’!
যে দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি যৎসামান্য গুরুত্ব পায়, পরিবার আর বন্ধুমহলের কাছে বিন্দুমাত্র পাত্তা না পেয়ে ‘নাটুকেপনা’ হিসেবে খারিজ হয়ে যায়; সে দেশে আনুশকা-দীপিকার মতো সমাজের দুজন মর্যাদাসম্পন্ন নারী এমন অকপটে কথা বলছেন নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে- এটা ভারতীয় সমাজের বিবেচনায় সাহসেরই বিষয়!
এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়াদি সব সময় কড়াভাবে ঢেকে রাখাটাই সমীচীন মনে করে বলিউড। বলিউড নিজের ক্ষতস্থান ভালোভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারে। বলিউড নিজের রহস্যগুলোকে ‘রহস্য’ হিসেবেই রেখে দিতে চায় এবং পারেও। ‘মানসিক স্বাস্থ্য’-সংক্রান্ত বিষয়টি থেকে বলিউডের অবস্থান সব সময়ই যোজন যোজন দূরে। ’৯০-এর দশকে পারভিন ববির ভগ্ন মানসিক দশা, কিংবা ’৭২ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে গীতা দত্তের মৃত্যু- সবকটি ঘটনাতেই বলিউড একদম চুপটি মেরে থেকেছে! অন্য গল্পগুলোর দিকেও একনজর দেখুন : মীনা কুমারী কি আসলেই পানাসক্ত ছিলেন? তিনি কি অশরীরী আত্মার মাঝে শান্তি খুঁজতে চেয়েছিলেন? আর চাইলেও সেটা কেন চেয়েছিলেন? কিসে মৃত্যু হয়েছিল রাজেশ খান্নার? ক্যান্সার, মদ না নিঃসঙ্গতা? বলিউডের বহু তারকা বিশাল অর্জন আর জনপ্রিয়তার পর শেষমেশ এমন ‘ব্যক্তিগত নরকে’ পুড়ে জীবন শেষ করে দিয়েছেন। কেন?
আর এখনো পর্যন্ত, এই ‘ইতিহাস’-এর কিছু কদর্য সত্যকে কেউই উন্মোচন করেননি। এ জন্য অবশ্য কেউ প্রস্তুতও নন।
এমন অবস্থা রাতারাতি বদলে যাবে তা নয়! অতীতে অকালে ঝরে যাওয়া অনেক তারকাদের নিয়ে গুঞ্জন শোনা যায় সমাজে- অমুক মাদকে ডুবে থাকতেন, কেবল মদই খেতেন, অপ্রকৃতিস্থের মতো কথা বলতেন, উদ্ভট আচরণ করতেন, বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে একদমই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন- তারপর দিনদিন আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন ইত্যাদি। শেষমেশ কোনো একদিন একেবারে একাকী, দীনহীনের মতো নীরবে মৃত্যুবরণ! মৃত্যুর আগে ছিটেফোঁটা সম্মান, জৌলুস, কিছুই অবশিষ্ট থাকে না- এই তো! কার কী বা যায় আসে? তিনি কেমন ছিলেন আর কোন সমস্যায় ভুগছিলেন, সেটা কারই বা খুঁজে বের করার দায় পড়েছে? যাঁরা পর্দায় উপস্থিত নেই, যাঁরা ছিটকে দূরে চলে গেছেন- বলিউডে তাঁদের জন্য কোনো জায়গাই নেই! যারা মানসিকভাবে বিপদাপন্ন, ভগ্নস্বাস্থ্যের, তীব্র মানসিক চাপের সাথে পেরে উঠছেন না, সামলাতে পারছেন না দায়িত্ব- তাঁদের নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ নেই বলিউডের!
দীপিকা আর আনুশকা এখানেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। কেবল বলিউডে নয়, আরো বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে। মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে আমাদের মোটামুটি সচেতনতাও কাজ করে না। অধিকাংশ মানুষই এমন সমস্যায় ভোগা মানুষদের দুটো দলে ফেলে খালাস হয়ে যান, হয় ‘পাগল’ নয় তো ‘উন্মাদ’। দুর্ভাগ্যবশত, পারভিনকে দেগে দেওয়া হয়েছিল ‘উন্মাদ’ হিসেবে। বাইরের দুনিয়ার কারো সাথেই তিনি যোগাযোগের ‘উপযোগী’ ছিলেন না, দুর্বোধ্য আর ধরাছোঁয়ার বাইরেও চলে গিয়েছিলেন তাই!
সবার কাছ থেকে পরিত্যক্ত হয়ে তিনি বন্দি হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ দুনিয়ায়। ববি লড়েছেন মনের আতঙ্ক আর ভয়ের সাথে। অনেকেই তখন ববিকে এড়িয়ে চলেছেন। তাঁকে এড়ানো তেমন কোনো কঠিন কাজও ছিল না। এককালের অপরূপ সৌন্দর্য আর মোহনীয় দেহের অধিকারী পারভিনের শরীরটা শেষমেশ আর তেমন থাকেনি, মৃত্যুর পর তাকে শনাক্ত করাও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেকে বাঁচাতে পারেননি, আর তাঁকে বাঁচাতেও কেউই আসেননি।
শোবিজে থাকার মানসিক চাপ আর উদ্বেগ কতটা চরম মাত্রার, সেটা শোবিজে যাঁরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তাঁরাই ভালো বোঝেন; বিশেষ করে যাঁরা দীপিকা ও আনুশকার মতো তারকা।
অধিকাংশ সময়েই ভক্তরা হয়তো এভাবেই পড়েন বা শোনেন- অমুক বা তমুক তরুণী অভিনেত্রী শুটিংয়ের সেটে ‘অজ্ঞান’ হয়ে গিয়েছিলেন, বা ‘মাথা ঘুরে’ পড়ে গিয়েছিলেন। কারণটা দেখানো হয় শারীরিক ক্লান্তি, পরিশ্রম ইত্যাদি। কিন্তু কারণটা কিন্তু অন্যরকমও হতে পারে। শারীরিক সমস্যার ‘মানসিক’ সমস্যার সম্ভাবনাই কিন্তু বেশি। এটা মেনে নেওয়া কি খুব বেশি কষ্টকর? দীপিকা আর আনুশকার কাছ থেকে আসা এই সময়ানুগ স্বীকারোক্তি হয়তো পরিস্থিতি পরিবর্তনে সহায়তা করবে। মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি আগের মতো কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখার বদলে এখন হয়তো গুরুত্বের সাথে দেখা হবে।
সমাজ গরজে আনলে এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান সম্ভব নয়। হোক তা মানসিক কি শারীরিক! এখনই উত্তম সময় সচেতন হওয়ার।
বি.দ্র.
এনটিভি অনলাইন সকল মত ও পথের লেখকদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী। তবে সেই রচনায় লেখকের মতের সঙ্গে এনটিভির সম্পাদকীয় নীতি বা মত সবসময় অভিন্ন হবে এমন ভাবার অবকাশ নেই। ভিন্নমতকে প্রকাশের সুযোগ দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক চর্চায় শামিল হচ্ছি কেবল।