স্মরণ
মুক্তি পথিকৃৎ সেই দিনটি আজো অস্বীকৃত!
ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা একাধারে একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (তৎকালীন রিডার) ছিলেন। স্বৈরাচারী আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রদের জন্য তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাই তো ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুলেটের মুখে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের একজন সাহসী শিক্ষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার এই বীরত্বগাথা ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি দেশের জনগণকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান, ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ড. শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু দেশেবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।
তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক ড. শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু দেশবাসীকে বেশি বিব্রত করেছিল, করেছিল অনুপ্রাণিত। বিশেষ করে ছাত্রসমাজের মধ্যে আন্দোলনের বীজ দানা বাঁধতে শুরু করে এ ঘটনার পরপরই। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার মৃত্যুর পর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন হলেও জাতীয়ভাবে এখনো তার স্বীকৃতি মেলেনি। শামসুজ্জোহা শহীদ হওয়ার ৪৭ বছর পার হলেও ১৮ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন না করতে পারা আমাদের জন্য অভিশাপের কিছু না হলেও অন্তত এটাকে যেকোনো বিবেকবান আশীর্বাদের বলবেন না, যদি তিনি প্রকৃত ইতিহাস জেনে থাকেন। আজকের দিনে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকরা মাঝেমধ্যেই যে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তাতে করে সময় এসেছে ড. শহীদ শামসুজ্জোহার মতো আদর্শবান শিক্ষকদের ইতিহাস চর্চার। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি শুধু জীবন উৎসর্গই করেন নাই, ‘আজ আমি ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ ১৯৬৯ সালে শামসুজ্জোহা এমন কথা বলেছিলেন। এমন একটি বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি যে প্রতিবাদী কণ্ঠের আওয়াজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সচেতন সমাজে, সে প্রতিবাদ আজো চলছে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভরত ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত হন প্রিয় এ শিক্ষক। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র আহত হন। পরে সেখান থেকে শামসুজ্জোহার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ জিপে করে রাজশাহী শহরের মিউনিসিপ্যাল ভবনে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়। সেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শামসুজ্জোহার নির্জীব দেহকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় দুপুর দেড়টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বাঙালির বীরত্বময় গৌরবগাথার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁর মৃত্যুর পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছিল। তাঁর রক্তের পথ ধরেই পতন ঘটেছিল সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের। গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল বাঙালির।
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের পথে যে আন্দোলন পরিক্রমা ধারাবাহিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার মধ্যে ড. জোহার শহীদ হওয়ার প্রেক্ষাপটটি অন্যতম। ড. জোহার মৃত্যু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল। এবং এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, যা দেশকে স্বাধীন করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর তাঁর অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সম্মানে ভূষিত করা হয়। নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে স্বাধীনতার পর তাঁর নামে চার টাকা মূল্যের ডাকটিকেট অবমুক্ত করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ শামসুজ্জোহা হল’। ওই হলটির সামনে নির্মাণ করা হয় 'স্ফুলিঙ্গ' নামে জোহার স্মৃতি ভাস্কর্য। শহীদ হওয়ার ৪৭ বছর পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে নির্মাণ করছে শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই শামসুজ্জোহার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে অনেক আগে থেকেই একটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিবছর জোহা সিম্পোজিয়াম পালন করে থাকে। সম্প্রতি দেশের শিক্ষকসমাজ ড. জোহার মৃত্যুদিবসকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসছে। দিবসটির যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হোক। তিনি যে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন দিয়ে গেলেন, তা আমাদের মধ্যে অনুসরণীয় হয়ে থাক। আর কালের পরিক্রমায় এ চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক শিক্ষক সমাজসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে।
শামসুজ্জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী
ড. শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৯৪৮ সালে এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালের পর শামসুজ্জোহার পরিবার স্থায়ীভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। ১৯৫৩ সালে জোহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে সম্মান ও ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহকারী কারখানা পরিচালক পদে শিক্ষানবিশ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে বিস্ফোরকদ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি ইম্পেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এআরসিএস ও বিএস স্পেসিয়াল ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। বিদেশ থেকে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি নিয়ে পুনরায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। জোহা শহীদ হওয়ার সময় স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যাসন্তান রেখে যান।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়