ক্রিকেট
আইসিসি, সামথিং ইজ রং..
মাশরাফির চোখ লাল, চোখের কোল ভেজা। শুকনো দাগ। মাশরাফি সব সময়ই বলেন, খেলার চেয়ে জীবন অনেক বড়! তিনি তাই খেলা নিয়ে কাঁদেন না। দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের অজস্র বিপর্যয়েও মাত্র একবার কেঁদেছিলেন। হয়তো তার দর্শনে ক্রিকেটের চেয়ে জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেই। সেই মাশরাফি আবার কাঁদলেন। প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলেন না। কাঁদলেন। তারপর মাঠে নামলেন। কিন্তু মাঠে যিনি নামলেন, তিনি কোনোমতেই সেই সংশপ্তক মাশরাফি নন, এই মাশরাফি বিপর্যস্ত এক মানুষ হয়ে। যেন বহু কষ্টে বুকের ভেতর চেপে রেখেছেন কান্না কিংবা ক্রোধ। দুঃখ কিংবা দাবানল।
কেন?
মাশরাফি সেই জবাবটিও দিয়েছেন, আমি আমার নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবি না। কিন্তু তাসকিন, যেই ছেলেটা এই দেশের হয়ে আরো কমপক্ষে ১০টি বছর খেলতে পারত, সেই ছেলেটার জন্য... তার প্রতি যা করা হয়েছে, তা অন্যায়...
মাশরাফি কথা শেষ করতে পারেননি। তাঁর গলা বুজে এসেছে! কারণ মাশরাফি মুখে বললেও তিনি গভীরভাবেই জানেন, এই দেশের মানুষের কাছে জীবনের চেয়ে কম কিছু নয় ক্রিকেট!
তাহলে?
মাশরাফিকে যুক্তিহীন আবেগি মানুষ কেউ বলতে পারবেন না। তিনি যুক্তিতে চলেন। সেই যুক্তি প্রবল। তিনি ষোল কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি যুক্তিতে কঠোর। বহুবার আবেগ দূরে সরিয়ে রেখে তিনি কঠোর কণ্ঠে বহু কিছু মেনে নিয়েছেন, নির্বাক! কিন্তু এবার? এবার সেই তিনিই কেন বললেন, তাসকিন ইস্যুতে আইসিসির কাছে বোর্ডকে শক্ত পদক্ষেপে জবাবদিহিতা চাইতে! তিনি কেন বললেন, তাসকিনের সঙ্গে যা হয়েছে, তা কোনোভাবেই জাস্টিস না! বিশ্বকাপের মতো আসর চলাকালে, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে কোড অব কন্ডাক্টকে থোড়াই কেয়ার করে আবেগে থরথর কণ্ঠে এমন বললেন, কেন?
কারণ, কিছু একটা সত্যিই ঠিক নেই! একদম ঠিক নেই! আসলেই ঠিক নেই! সাম থিং ইজ রিয়েলি রিয়েলি রং!
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যে নো বল ইস্যু, বাউন্ডারি ইস্যু, তাতে গোটা দেশ ফুঁসে উঠলেও, তিনি টু শব্দটি করেননি। কারণ তিনি ক্যাপ্টেন। তিনি জানেন, চাইলেও তিনি অনেক কিছুই বলতে পারেন না। এরপরও ঘটনা ঘটেছে অনেক। কিন্তু মাশরাফি সব সময়ই কেবল আরো ভালো খেলার কথা বলেছেন। কেবলই খেলা। আরো কিছুই না। কেবলই আরো ভালো খেলা। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি। কিন্তু সেই মাশরাফি, যিনি তাঁর বিশাল বুকের প্রগাঢ় ছায়ায় আগলে রাখেন বাংলাদেশ টিম! সেই মাশরাফিকে আজ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলায় যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, কাকে দেখছেন? কোন মাশরাফিকে! ধারাভাষ্যকাররা অবধি বলছেন, ‘হি ইজ লুকিং ব্রোকেন...’
মাশরাফি ভাঙেন না। একথা কে না জানে! কিন্তু সেই মাশরাফি, মাঠে, মাঠের বাইরে যেন কোনো এক রহস্যময় ভয়ংকর ঝড়ে বিধ্বস্ত বটবৃক্ষ! সেই ঝড়ের নাম কি?
আপাতত, দৃশ্যমান সেই রহস্যময় ঝড়ের নাম আইসিসি। অন্যায্য উপায়ে, নিজেদের আইন নিজেরাই ভেঙে আইসিসি যেভাবে তাসকিনকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে, সেটি সুস্পষ্টভাবেই একটি ভয়াবহ অশনিসংকেত। একটি ভয়াবহ নীলনকশার প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ! এই অশনিসংকেতের সামনে দাঁড়িয়ে মোস্তাফিজ, আল-আমিন, সাকিব, রনি আরো অনেকেই। এটি হেলাফেলার বিষয় নয়। একটু তাকান, তাকালেই দেখবেন, আইসিসি এর আগে ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশে সফলতম স্পিনার রাজ্জাকের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ করে! তারপর রাজ্জাক ফিরে এসেছেন আর? সংশোধিত বোলিং অ্যাকশন নিয়ে? সেই আগের রাজ্জাক? আসেননি! এমন উদাহরণ আরো আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কততম ম্যাচে এসে আইসিসির নজরে পড়ল, রাজ্জাকের বোলিং অ্যাকশন ত্রুটিপূর্ণ? কী অদ্ভুত না? তাহলে এর আগে যে তিনি ভূরি ভূরি ম্যাচ খেলেছিলেন, তখন কি তাঁর অ্যাকশন বৈধ ছিল? নাকি সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড়দের ধ্বংসের এ এক নীল নকশা?
না হলে তাসকিন যখন এশিয়া কাপ খেললেন, সেই ম্যাচেও আম্পায়ার ছিলেন এস রবি এবং রড টাকার। তাহলে? এক সপ্তাহর ব্যবধানে বোলিং স্টাইল ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেল তাসকিন আহমেদ এবং আরাফাত সানির? কী অদ্ভুত না?
আইসিসি বলেছে, ‘তাসকিনের কিছু ডেলিভারিতে সমস্যা প্রমাণিত হয়!’
এর চেয়ে হাস্যকর যুক্তিতে ক্রিকেট ইতিহাসে কোনো বোলারকে নিষিদ্ধ করা হয়নি! কিছু ডেলিভারিতে সমস্যা হলে, আইসিসি কোনোভাবেই সেই বোলারকে নিষিদ্ধ করতে পারে না। বরং তাকে সেই সকল ডেলিভারি দিতে নিষেধ করতে পারে, বা ওই সব ডেলিভারির ক্ষেত্রে অ্যাকশন শুধরে আসতে বলতে পারে। এর প্রমাণ আছে ভূরি ভূরি। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়োহান বোথা, তাঁকে দুসরা দিতে নিষেধ করা হয়েছে! কারণ তাঁর দুসরায় সমস্যা ছিল। তাহলে?
তাহলে কী! সেটি ভাবনার বিষয়। সেই ভাবনাজুড়ে এক বিষাক্ত ফণার ছবিই বারবার ভেসে উঠছে চোখে। এর বিষাক্ত ছোবলে বারবার নীল হচ্ছে বাংলাদেশ!
এখনই সময়, সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ জবাবদিহিতার জন্য প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ানোর। সেটি বোর্ড এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও হতে পারে! হতেই হবে! না হলে প্রবল অপ্রাপ্তির, হতাশার, পরাজয়ের এই জীবনে এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ খানিকটা উল্লাসে মেতে ওঠার কারণটুকু হারিয়ে ফেলবে, হাসিতে-আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কারণটুকু হারিয়ে ফেলবে। হারিয়ে ফেলবে, জীবনও।
কারণ, এখানে, এই দেশে, ক্রিকেট জীবনের চেয়ে কম কিছু নয়!
লেখক : গল্পকার