দৃষ্টিপাত
রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও শ্রমিকের স্বার্থ
রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে বাঁচানোর জন্য সন্তোষজনক হারে নগদ অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানকার পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং একইসঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পণ্য পরিবহন ভাড়া কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহের ঘাটতি উৎপাদনকে যেন ব্যাহত না করে সেই চেষ্টায় সরবরাহ ঠিক করা হয়েছে।
সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার তৃতীয় বার্ষিকীতে এসে সেই ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের চিত্রগুলো বারবার মনে পড়ছে। শত শত মানুষের আর্তনাদ আর রক্তাক্ত আহত, নিহত দেহগুলো সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। সেদিন শুরু হওয়া ওই উদ্ধারকাজ ২১ দিন পর ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল এক হাজার ১১৭ টি। হাসপাতালে মারা যান ১৮ জন। সর্বমোট এক হাজার ১৩৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ৮৪৪টি মরদেহ শনাক্ত করে মৃতদেহ আত্মীয় স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং ২৯১টি মরদেহ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে দাফন করা হয়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে চলেছে দেশি-বিদেশিদের গভীর ষড়যন্ত্র। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা করেছে।
রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলায় সেই সময় সরকারের তৎপরতা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাৎক্ষণিক আর্থিক সাহায্য করেন। নিহতদের পরিবার ও আহতদের সব ধরনের সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, সংসদ সদস্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং উদ্ধারকাজ তদারকি করেন।
জেলা প্রশাসন, ঢাকা লাশের দাফন-কাফন ও সৎকার, আহতদের তাৎক্ষণিক প্রদান, নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রদান, উদ্ধারকাজের জরুরি যন্ত্রাংশ ক্রয় ইত্যাদি বাবদ মোট দুই কোটি ৫৩ লাক ৮৫ হাজার ৮১৮ টাকা দেওয়া হয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হয়েছে এমন আহতদের শরীরে কৃত্রিম হাত-পা সংযোজন করা হয়। এজন্য থাইল্যান্ড থেকে ডাক্তার ও সহকারীরা এসেছিলেন। তাঁরা কোনো অর্থ নেননি। কিন্তু তাঁদের থাকা এবং কাজের জন্য এক কোটি টাকার আনুষঙ্গিক খরচ হয়েছে। দুর্ঘটনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা করা হয়। আহতদের সাভারের সিআরপি থেকে চিকিৎসা করানো হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নিহতদের আত্মীয়দের বাসে করে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে আনা-নেওয়া করা হয়। এ বাবদ অর্থ খরচ হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে সারা বৎসর ধরে দুঃস্থ ও পীড়িত মানুষদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে দুর্যোগকালীন দানশীল ব্যক্তিরা বা প্রতিষ্ঠান তহবিলে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত বা গুরুতর আহতদের প্রধানমন্ত্রীর এই ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৮ জন গুরুতর আহতের অনুকূলে অনুদান হিসেবে ‘পারিবারিক সঞ্চয়পত্র’ বাবদ চার কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ৮০৬ জন নিহতের পরিবারের সদস্যের মাঝে ১০৬১টি চেক অর্থাৎ বার কোটি বায়ান্ন লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।
এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে (১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ পর্যায়ে) শনাক্তকৃত মোট ১৭২ নিহতের ২৩৭ জন নিকটাত্মীয়ের অনুকূলে অনুদান দুই কোটি নব্বই লাখ টাকা দেওয়া হয়। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক এজাজউদ্দিন চৌধুরী কায়কোবাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হয়েছে সিঙ্গাপুরে প্রেরণে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া এবং চিকিৎসা বাবদ অনুদান এক কোটি পাঁচ লাখ ছিয়ানবব্বই হাজার সাতশত বিশ টাকা।তাঁর স্ত্রী বেগম জারমিন ও দুই সন্তানকে বার লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের খরচ নির্বাহের জন্য ২২টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনুকূলে অনুদান এক কোটি বিয়াল্লিশ লাখ চৌদ্দ হাজার টাকা। অন্যান্য ব্যয় মিলে মোট ২২ কোটি ৯৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭২০ খরচ করা হয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা কর্তৃক উদ্ধারকাজ পরিচালনায় আনুষঙ্গিক ব্যয়ের চিত্রটি এ রকম : সশন্ত্রবাহিনী, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা জেলা ব্যতীত অন্যান্য জেলার জেলা প্রশাসকরা এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ব্যয় করেছে চার কোটি ৩৫ লাখ ৩৮ হাজার ২১৯ টাকা ৫৬ পয়সা। এ ছাড়া, অনুদানের চেক গ্রহণের নিমিত্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আগত নিহতদের নিকট-স্বজনদের ঢাকায় রাত্রিযাপন ও খাবার বাবদ বিজেএমইএর তরফ থেকে দুই লাখ ৭৬ হাজার ১৬১ টাকা খরচ করা হয়। দুর্ঘটনার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা জেলা শাখার তরফ থেকে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা করা হয়।
রানা প্লাজার ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়ে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা ইতিমধ্যে প্রশংসিত হলেও ষড়যন্ত্রকারীরা অপপ্রচার থামায়নি। যেমন, ঘটনাত্তোর শ্রমিক বান্ধব ব্যবস্থা ছিল এ রকম- রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি কারখানার দুই হাজার ৭৮৫ জন শ্রমিককে বিজিএমইএ বেতনসহ সববকেয়া পরিশোধ করেছে। বিজিএমই কর্তৃক ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। তৈরি পোশাকশিল্পের নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ রক্ষা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের আরো একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ১১ সদস্যের কেবিনেট কমিটিকে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সরকার এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১কে প্রধান করে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানায় ৪৯২ একর জমির ওপর একটি ‘গার্মেন্ট শিল্প পল্লী’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। পোশাকশিল্পের নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করতে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সরকার সারা দেশে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য ২৩টি পরিদর্শন টিম গঠন করে। টিমগুলো নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করছে এবং ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে দোষী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে সব তৈরি পোশাক কারখানার ডাটাবেইজ প্রস্তুত করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬, অধিকতর শ্রমিক বান্ধব করার জন্য ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া, জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম এখন আগের তুলনায় অনেক সহজ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আইএলওর সহযোগিতায় একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়। তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমমান ও নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ২০১৩ সালে Sustainability Compact গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্থগিত জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের শর্ত হিসেবে Bangladesh Action Plan ২০১৩ বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়। উক্ত কর্মপরিকল্পনার আওতায় প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যদিও ২০১৩ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ মোট ২৯৯ কোটি ৭২ লাখ ৩৩ হাজার মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল। কিন্তু বছর যেতে না যেতে তা ৫ কোটি ২৫ লাখ ৫৫ হাজার কমে ২৯৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৯ হাজার মার্কিন ডলারে নেমে আসে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।
আগে বলা হয়েছে, ৫ জানুয়ারির(২০১৪) নির্বাচনের আগের সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতা উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের অর্ডার প্রত্যাহার করে নেয়। জানা গেছে, এসব অর্ডার গেছে চীন ও ভিয়েতনামে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমলেও বেড়েছে ভিয়েতনাম ও চীনে।
আজ থেকে তিন বছর আগেই রানা প্লাজার দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ওই ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকেই আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্ট শিল্প। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করার পিছনেও রানা-প্লাজা-উত্তর শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।