জাগো বাহে
নদী মরছে না, মারছি
বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এই সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার নেপথ্যে প্রাকৃতিক কোনো কারণ নেই, কৃত্রিমভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে নদনদী। একসময়ে বাংলাদেশে দেড় সহস্রাধিক নদী ছিল। এখন সেই সংখ্যা বর্ষা মৌসুমে কয়েকশ হলেও শুষ্ক মৌসুমে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। এই হ্রাস পাওয়া নদীগুলো আপনা থেকে মারা যায়নি। নদীগুলোকে আমরা মেরেছি।
নদীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, নদী বিভিন্ন সময়ে তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পে, কখনো অনেক বড় বন্যায় নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে থাকে। যেমন তিস্তার (ত্রিস্রোতা) প্রধান প্রবাহ ছিল করতোয়া। করতোয়াকে ঘিরে একটি কিংবদন্তি আছে। ‘কর’ শব্দের অর্থ হাত, ‘তোয়’ অর্থ জল। বলা হয়ে থাকে, শিব বিয়ে করেছিল হিমালয়ের মেয়ে পার্বতীকে। বিয়ের সময়ে শিবের হাতে যে পানি ঢালা হয়েছিল, সেই পানি থেকে করতোয়া নদীর সৃষ্টি। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলা অধিকার করেন, তখন করতোয়া গঙ্গার চেয়ে তিনগুণ বড় ছিল। ১৭৮৭ সালে এক বিশাল বন্যায় তিস্তা নদী তার দিক পরিবর্তন করে। তখন করতোয়ায় তার প্রভাব পড়ে। এভাবে নদীর খাত পরিবর্তিত হয়। নদী একাংশে শীর্ণ হলে অন্য দিকে প্রাণিত হয়।
আমাদের দেশে নদীগুলো দুটি কারণে প্রাণ হারাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে নদীগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের কোনো যত্ন নেই। অন্যটি, আমাদের উজানে ভারত থেকে আসা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া।
আমাদের দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা অভিন্ন নদী ৫৭টির মধ্যে ৫৪টির উৎসই হচ্ছে ভারত। যদি অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো, তাহলে ভারত থেকে নেমে আসা নদীগুলোর পানি একতরফাভাবে ভারত সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের পানির প্রধান প্রধান উৎসগুলো বন্ধ করতে পারত না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহিরাঙ্গনে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক দৃশ্যমান হলেও পানি অধিকারের প্রশ্নে সেই সম্পর্কের কোনো প্রমাণ মেলে না। বরং তারা উজানের সব অভিন্ন নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নেওয়ার বন্দোবস্তই করছে।
২০১৪ সালের আগে অভিন্ন নদীতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘে কোনো আইন ছিল না। ফলে এর প্রতিকারের বিষয়ে কোনো সুযোগও ছিল না। ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইন প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছে পানির দাবিটি সব সময়ে দুর্বলভাবে করে আসছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে যে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেশন হয় সেখানে বাংলাদেশ সমর্থন করেছিল। ভারত-পাকিস্তান সেখানে সমর্থন করেনি। সেই কনভেনশনটির নিয়ম অনুযায়ী ৩৫টি দেশ অনুসমর্থন করলে সেটি আইনে পরিণত হবে। ৩৪তম দেশ স্বাক্ষরের পর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৫তম দেশের অনুসমর্থনের জন্য। বাংলাদেশ অনুসমর্থন করলেই সেটি আইনে পরিণত হতো। তবু বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেনি। বিশ্বে যতগুলো দেশ রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের জন্য এই আইনটি ছিল সবচেয়ে বেশি জরুরি। অথচ বাংলাদেশ অনুসর্মথন করেনি। এখন পর্যন্ত নয়। ভিয়েতনাম অনুসমর্থন করার মধ্য দিয়ে ৩৫ দেশের অনুসমর্থন হয় এবং তারপর থেকে এই কনভেনশনটি আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশ যদি চায় তাহলে অনুসমর্থন করে আইনি প্রতিকার চাইতে পারে। আইনি প্রতিকার চাইতে গেলেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে প্রতিকার চাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের পানির অধিকারের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশের নদীগুলোকে মেরে ফেলার মধ্যে শুধু ভারতের একতরফা দোষ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তার কারণ নদীগুলোকে মেরে ফেলার নেপথ্যে আমাদের রাষ্ট্রের ব্যর্থতাও কম নয়। নদী রক্ষায় দেশের অভ্যন্তরে কিছু আইনও প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রয়োগ চোখে পড়ছে না।
নদীর প্রতি যে আমাদের সরকার তৎপর নয়, কিছু কিছু নদীর দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন ধরা যাক ঘাঘট নদের কথা। এই নদ অনেক প্রশস্ত ছিল। সেই নদ এখন একটি সরু নালার মতো হলো কী করে? নদীতে যদি পানি না থাকে তবুও তো নদীর যে এলাকা ছিল সেটা থাকবে। নদীর নির্দিষ্ট এলাকা আর নেই। নদী দখল হচ্ছে। একদিকে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে নদী দখল হয়েছে, সেই সঙ্গে নদী খননও করা হয়নি কখনোই। এত অবহেলার মধ্য দিয়ে নদীকে বাঁচিয়ে রাখা একেবারেই অসম্ভব। আমাদের বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পানি দেখা দেয়। আর শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে যাতে করে নদীতে পানি থাকে সেই, ব্যবস্থা আমাদের নিতেই হবে। যদি সেটি করা সম্ভব না হয়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশের ওপর ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আমরা নদীর প্রতি যে অবহেলা প্রদর্শন করছি, এর পরিণতি কখনো ভালো হবে না। এখনো সময় আছে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় সন্ধান করার। অভিন্ন নদীগুলোতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারিভাবে নদীর পানিতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পানিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র জয় করেছে। আমরা মনে করি, নদীতেও সেই বিজয় আমরা আরেকবার দেখতে পারব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।