প্রিয় দীপিকা, অন্তর্বাস খোলা মানেই ক্ষমতায়ন নয় : শোভা দে
শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলামিস্ট। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি ‘ভোগ এমপাওয়ারমেন্ট’-এর ব্যানারে হোমি আদাজানিয়া ও দীপিকা পাড়ুকোনের উদ্যোগে নির্মিত ‘মাই চয়েজ’ নামের বহুল আলোচিত ভিডিওটির তত্ত্ব-তালাশ করেছেন তিনি। শোভা দে’র এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে গতকাল ৩১ মার্চ এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে।
আমি ঠিক জানি না সবার রাগটা কোথায়? মানুষজন কি ‘ভোগ’-এর উপরে খেপে আছে? না কি তারা আসলে ক্ষিপ্ত অন্য কিছুর ওপর?
‘ভোগ এমপাওয়ার’ ভিডিওটা আমি দেখেছি…আর হেসেছি। হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটা আসলেই মজার! ওদিকে, অনেকের কাছেই আবার ব্যাপারটা মজার ঠেকেনি, তারা ভীষণ চটে গেছেন! ভিডিওটা অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। আর সবাই চিৎকার করছে- এটা নারীর প্রতি অসম্মান…এত গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুকে উপেক্ষা করে কীভাবে তারা এসব অনর্থক ফটোশ্যুট করতে পারল? ক্ষমতায়ন মানে কি তাহলে দীপিকার অন্তর্বাসের বন্ধনী খোলা আর যন্ত্র দিয়ে বাতাসে চুল উড়ানোর বাহার? কেন সে এমন করল?
বেশ তো…তাহলে আপনারা এটা দেখছেন কোন দুঃখে?
চলুন দীপিকাকে দিয়ে শুরু করা যাক। মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের সাথে নিজের লড়াইয়ের কথা জনসমক্ষে সাহসীভাবে স্বীকার করা, মহাশক্তিধর টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাথে ‘বুকের ভাজ প্রদর্শনী’ নিয়ে তাঁর যুদ্ধ, তারপর এমন পদক্ষেপ! কিন্তু এই দশার কারণ কী? এ রকম আসলে মাঝেমধ্যে কেন হয়, সেটার একটি খসড়া কল্পনা অবশ্য করা যায়!
ধরুন, হোমি আদাজানিয়ার মতো একজন পরিচালক, যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে পেদ্রো আলমাদোভরকে নকল করে যায়, আশপাশে দীপিকা থাকলে তার মাথায় তো এমন কিছু আসতেই পারে! বিশেষ করে বিরক্তিকর, ক্লান্তি ধরানো আর স্বপ্নবিলাসী আজগুবি কোনো প্রকল্প নিয়ে তিনি যখন গোয়ায় কোনো শুটিং করতে থাকেন- তখন এমন নিকৃষ্ট জিনিস তৈরি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়! দীপিকাকে নিয়ে হয়তো হোমি ভাবেন- বাহ, আমি তো আমার পেনেলোপে ক্রুজকে পেয়ে গেছি! কাজেই একবার এসব ছবি বানিয়ে ফেললে তো আর ফেলে দেওয়া যাবে না! তখন তল্পিতল্পা বাঁচাতে ‘ভোগ’-এর কাছে যেতে হয়! কাজেই মানে মানে ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ সিরিজেরও তিন নম্বর কিস্তি বেরিয়ে পড়ে!
সবাই একটু মন দিয়ে শুনুন- এটা হচ্ছে ‘ভোগ’। পুরোদস্তুর মার্কামারা এক আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ম্যাগাজিন। ভোগের সবকিছুই হচ্ছে গ্ল্যামারের প্রচারণা আর প্রদর্শনীর জন্য। আসল ব্যাপার সেখানেই লুকানো, বোঝা গেছে?
যত কিছুই হোক, এগুলো দিয়েও কিন্তু আসলে এই ‘মাই বডি, মাই মাইন্ড, মাই চয়েজ’-এর উদ্ভট নির্মাণ ও প্রদর্শনীর ভুলচুকের হিসাবটা মেলানো যায় না। প্রচারণাটি এমন করে বানানোর পেছনে কার কী যুক্তি, আর কেনই বা তা এমন? আমার শরীরের ‘সুবাস’ কি আমার স্বামীর ‘পৌরুষত্ব’র সাথে মেলানোটা খুব যৌক্তিক? আমি ব্যাপারটা নিয়ে এভাবেও ভেবেছি- ধরুন কোনো এক সকালে আমার স্বামী ডাইজেস্টিভ বিস্কুটে কামড় দিচ্ছেন। তখন যদি আমি এ রকম কিছু একটা বলি, ‘ওহে, আমি কিন্তু তোমার কোনো ধার ধারি না বা আমার ওপর তোমার কোনো অধিকার নেই’-তখন? সে তখন বিস্কুটে কিভাবে কামড় দেবে তা জানি না, তবে নিশ্চয়ই এমন কিছুই বলবে- ‘বটে, তা নিজেকে তুমি ভাবোটা কী?” তোমার বাচ্চা নেব কি নেব না- ‘মাই চয়েজ’ এটা বলাটাও কি আসলে কোনোভাবে যৌক্তিক? অবশ্য তা বলার সময়ও নেই। বেশ কয়েকটা তো এরই মধ্যে নেওয়া হয়ে গেছে!
‘ফ্লেক’ দীপিকা, ইয়ে মানে ‘স্নোফ্লেক’ বা তুষারকণা(!)দীপিকা এই ভিডিওতে সব নারীকে বলছেন, ‘আমি তুষারকণা, তুষারপাত নই, আপনিও তুষারকণা!’ এর মানে কি রে ভাই!
মানে হলো ঘোড়ার ডিম, একেবারে শূন্য। এখানেই মূল কথা। এই অর্থহীন জিনিসটার অর্থ খোঁজা বন্ধ করুন। যে জিনিসটা আসলে কিছুই হয়নি তার বিশ্লেষণ বন্ধ করুন। একটু হাসতে চাইলে ভিডিওটা দেখুন, দেখে এক ফুঁতে উড়িয়ে দিন। এই ভিডিওতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে এবং যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার আসলেই ভাববার আছে- তা হচ্ছে স্টাইল আর ফ্যাশন। চুলে দীপিকা কতটা মুজ লাগিয়েছিল? আর অন্য কোনো কিছু লাগিয়েছিল কি না? না কি বিশেষ স্প্রে ছিল? এই ঘন চুলের রহস্য কী? আসলেই কি এগুলো প্রাকৃতিক চুল, নাকি আলগা চুলও আছে খানিকটা? লাইটিংয়ের কাজ কে করেছে? কোন আন্তর্জাতিক শ্যাম্পোর ব্র্যান্ড গোপনে এই প্রোজেক্টটার স্পন্সর হয়েছে কি না? যেসব নারী মাথার চুল খাটো রাখে তাদের কি একটু দমিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে কি না? ইত্যাদি।
হয়তো বা এটা কোনো বিশেষ অস্তিত্ববাদী, পরীক্ষামূলক ধারার ভিডিওচিত্র! এর হিসাবকিতাব হয়তো খুব উচুদরের নন্দনতাত্ত্বিকরাই বুঝবেন, যাঁরা নিশ্চয়ই ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন- হয়তো বা ভিন্ন গ্রহেও বসবাস করেন।এই আমজনতার ‘আম’ নারীরা নিজেদের ক্ষমতায়নের দেখভাল আসলে নিজেরাই করতে পারবেন। কতটা পারবেন তা জানি না, তবে বাইরের জঘন্য দুনিয়ায় বেরোবার আগে অন্তত নিজের চুলটা ঠিকমতো শুকিয়ে নিতে পারবেন নিশ্চয়ই!
আর হ্যাঁ, আমার কাছে এই ভিডিওটার এক পয়সাও দাম নেই।
মাই বডি, মাই মাইন্ড, মাই চয়েজ।
মনে আছে নিশ্চয়ই!