আমাদের প্রিয় হক ভাই : শিল্পের ভুবনে অমর
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক জন্মের পর কুড়িগ্রামের আকাশ দেখেছেন। কুড়িগ্রামের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। জন্মের পর যে আকাশ দেখেছেন, যে মাটি শরীরে মেখে মেখে পথ চলতে শুরু করেছেন, সেই পথ চলার শেষ হলো ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬। সৈয়দ শামসুল হক আপনার থেকেই কুড়িগ্রামের মাটিতে শায়িত হতে চেয়েছেন। গত কয়েক বছরে তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা বহুবার প্রকাশ করেছেন। গত ২ এপ্রিল ২০১৬ কুড়িগ্রামে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল রেল-নৌ-বন্দর-পরিবেশ উন্নয়ন গণ কমিটি। সেই অনুষ্ঠানেও তিনি মৃত্যুর পর কুড়িগ্রামে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর বোধে উজ্জ্বলতর হয়ে ছিল কুড়িগ্রাম।
সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রাম জেলায় মৃত্যুপরবর্তী শায়িত হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করার পর থেকে ‘রংপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ের লেখক কুড়িগ্রাম আইন কলেজের অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন তৎপর হন। তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের মাঠে স্থানও নির্ধারণ করেন। গত এপ্রিল মাসে শেষবারের মতো সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রামে আসেন। তখন কবির স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকসহ সন্তান দ্বিতীয় হককে সেই জায়গাটিও দেখিয়ে গেছেন। সৈয়দ শামসুল হক সারাজীবন জলেশ্বরীর কথা লিখেছেন। সেই জলেশ্বরী হচ্ছে কুড়িগ্রাম শহর। জলেশ্বরীতে একটি মাজার আছে। সেই মাজারটি কবিকল্পনায় সৃষ্ট। তিনি যে আধকোষা নদীর নাম ঘুরে ফিরে লিখেছেন সেটাও কুড়িগামের ধরলা নদী।
গত এপ্রিলের আগে গত মার্চ মাসেও সৈয়দ শামসুল হক এসেছিলেন রংপুর। সেবার রংপুরে এসেই এক ঘণ্টার জন্য গিয়েছিলেন কুড়িগ্রাম। রংপুরে এসেও তিনি যেটুকু সময় পেয়েছিলেন তাঁর পরিচিত রেল স্টেশন, শতরঞ্জি পল্লী, শ্যামাসুন্দরী খালের পাড়ে গিয়েছিলেন। ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ তাঁর প্রায় সব রচনার মধ্যেই কোনো না কোনোভাবে কুড়িগ্রাম-রংপুরের কথা লিখেছেন। একজন মানুষ দীর্ঘ ৬০ বছরর ধরে কীভাবে একটি এলাকাকে বারংবার সাহিত্যে নিয়ে আসতে পারেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত সৈয়দ শামসুল হক।
দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে তিনি দীপ্ত পদচারণায় মুখর ছিলেন। শিল্পের পরতে পরতে যে মাটি ও মানুষকে তিনি চিত্রিত করেছেন সেই জনপদের মাটিতেই তিনি এখন মিশে থাকবেন।
কুড়িগ্রামের জন্য তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ছিল। গত বছর যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামে এসেছিলেন, তখন তিনি সৈয়দ শামসুল হককে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক সেদিন বলছিলেন কুড়িগ্রাম এখন আর মঙ্গার জেলা নেই। তিনি পরবর্তী সময়ে আমাদের বলেছেন, ‘আমি শেখ হাসিনাকে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেনের কথা বলেছি।’
সৈয়দ শামসুল হক বৈরালী নামক একপ্রকার ছোট মাছ খেতে পছন্দ করতেন। সেই মাছটি কুড়িগ্রামের বাইরে খুব কম পাওয়া যেত। মাঝে মাঝেই আনোয়ারা সৈয়দ হক মাছের বাজারে যেতেন সেই মাছ কিনতে। সেই মাছ ঢাকায় সাধারণত পাওয়া যায় না। কুড়িগ্রামে এলে তিনি সেই মাছ খেতেন। কুড়িগ্রামে এক প্রকার আলু পাওয়া যেত যে আলুতে ভালো আঠালো আর খুব সুস্বাদু ভর্তা হয়। তিনি কুড়িগ্রামে এলে সেই আলু নিয়ে যেতেন।
সেই যে টাইফয়েডে আক্রান্ত কিশোর বিছানায় শুয়ে শুয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন আর তার সমাপ্তি হলো ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬। ছোটগল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক-কাব্যনাট্য-গান-প্রবন্ধ সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর সাফল্যের স্বাক্ষর রয়েছে। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যেই ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছেন।
গত মার্চের নারী দিবসে যখন সৈয়দ হক রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তখন তাঁকে আমি সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। যেতে যেতে তিনি এলাকার অনেক কথাই বলছিলেন। তিনি বলেছিলেন এরপর যখন তিনি কুড়িগ্রামে আসবেন তখন তিনি রাজারহাটের পাঙ্গা নামক স্থানে যেতে চান। সৈয়দ শামসুল হক আর কোনো দিন পাঙ্গা যাবেন না। পাঙ্গার নিকট দূরত্বেই তিনি চুপচাপ মাটি ও মহাকালের অংশ হয়ে থাকবেন।
রংপুরের আরডিআরএস নামক বেসরকারি সংস্থার রেস্টহাউজে কয়েক দিন থাকতে চেয়েছিলেন। লেখালেখির জন্য নাকি জায়গাটি খুবই উপযোগী। কিন্তু সেখানেও আর তাঁর কোনো দিন আসা হবে না। কবি ১১৭ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন। লালনের চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচার ইচ্ছে ছিল তাঁর। তাত্ত্বিকভাবে বললে বলা যায়, লালন মারা যাননি, মারা যাবেন না। তেমনি সৈয়দ শামসুল হক মারা যাননি। সৈয়দ শামসুল হকের শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও অশরীরী এবং শিল্পী সৈয়দ শামসুল হক সতত উপস্থিত থাকবেন আমাদের মাঝে।
ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হকের চেয়ে শিল্পী সৈয়দ শামসুল হকের প্রাণশক্তি অগাধ। কালের অনিবার্য বিচারে ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হকের প্রস্থান অনতিক্রমণীয়। শিল্পী সৈয়দ শামসুল হক স্থায়ী নিবাস গড়েছেন শিল্পের ভুবনে। এখন থেকে আমরা সেই ভুবনেই পাব আমাদের প্রিয় সৈয়দ শামসুল হককে। আমাদের প্রিয় হক ভাইকে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।