আলোর পথে যাত্রার আট বছর
দেশ বিভাগের পরপরই দাবি উঠেছিল, রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। সেই দাবি কিছুটা বাস্তবায়নের মুখ দেখেছিল ২০০১ সালে। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প বন্ধ করে দেয়।
২০০৮ সাল। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। রংপুরবাসী তখন রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে অনড়। রংপুরবাসীর আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিচার করে যে স্থানটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. এম লুৎফর রহমান।
রংপুরবাসী দেখেছে, শুধু ভিত্তি স্থাপন করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিলেই বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ২০০১ সালেই। তাই তাঁরা দাবি তুললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা কিছুই নিয়োগ হয়নি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ভর্তি করাটা ছিল অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. দীপকেন্দ্রনাথ দাস। তিনি তাঁর শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম বছরের ভর্তির কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেন।
প্রথমবার যখন শিক্ষক নিয়োগের তারিখ নির্ধারণ করা হয়, সেই তারিখটি অনিবার্য কারণ উল্লেখ করে স্থগিত করা হয়। প্রথম বছরে ছয়টি বিভাগে তিনশ শিক্ষার্থীর অভিভাবক ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটি আশঙ্কা কাজ করতে থাকে, আদৌ রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে কি না। তার কয়েক দিন পর প্রথমবারের মতো ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়। প্রতিদিন অনেক শিক্ষার্থী এসে শিক্ষকদের দেখে যেতেন।
শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও কোথায় হবে তাঁদের প্রথম অবস্থায় পাঠদান, এ নিয়ে অনেক খোঁজখবর শেষে রংপুর শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবন সংস্কার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরিত্যক্ত ভবনে শুরু হয়েছিল প্রথম উপাচার্যের কার্যক্রম। উপাচার্য একেবারে শুরুতে দুই ফুট বাই দুই ফুট মাপের দুটি টেবিল জোড়া দিয়ে একটি পুরাতন চেয়ারে বসে তাঁর অফিস শুরু করেন। রিকশায় করে যাতায়াত করতেন। সেই সময়ের জনতা ব্যাংক লালবাগ শাখার ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান উপাচার্যের অনুমতি সাপেক্ষে উপাচার্যের উপযোগী একটি ভালো টেবিল ও ভালো চেয়ার জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে উপহার দেন। সরকারের উচ্চমহল থেকে উপাচার্যকে রিকশায় করে অফিস করতে নিষেধ করা হয়। যত দিন গাড়ি কেনা না হয়, তত দিন একটি গাড়ি ভাড়া করার জন্য বলা হয়। উপাচার্য একটি ভাড়া করা গাড়িতে করে অফিস করতেন। এরই মধ্যে প্রথম রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আলাউদ্দিন মিয়া। তিনি পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রথম ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ পান সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোজাম্মেল হক।
২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ থেকে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূর হয়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
৩০০ শিক্ষার্থী, ১২ শিক্ষক, অস্থায়ী ক্যাম্পাস। সময়টি তখন ২০০৯ সাল। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা নয় হাজার। শিক্ষকও প্রায় দেড়শ। বিভাগ ছয়টির স্থলে ২১টি। এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে আটটি ব্যাচ। অনেক বিভাগে তৃতীয় ব্যাচেরও স্নাতকোত্তর প্রায় শেষ। অনেকেই সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েছেন। সেই অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জীর্ণ ভবন, বিশাল কাঁঠালগাছ এখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিমাত্র।
প্রথম উপাচার্য মাত্র কয়েক মাস দায়িত্বে ছিলেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অভিশাপ হিসেবে আসেন দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক মু. আবদুল জলিল মিয়া। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নীতি-রীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অবৈধ সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন। ছয় শতাধিক অবৈধ নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। এসব অবৈধ নিয়োগের বেতন দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ফান্ডে প্রায় আট কোটি টাকা থাকার কথা ছিল, সেখানে রেখেছিলেন ১৩০ টাকা ১১ পয়সা মাত্র। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ঋণেও ফেলেছিলেন।
দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল জলিল মিয়ার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে তিনি প্রতিবাদী শিক্ষক-কর্মকর্তার নামে অন্যায়মূলক মামলা করেছিলেন। চারজন শিক্ষক ও দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন। তাঁরা পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট থেকে চাকরি ফিরে পান।
অধ্যাপক আবদুল জলিল মিয়া তাঁর অপরাধের কারণে মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেননি। দুদক তাঁর নামে মামলা করেছে। শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই তাঁর নামে চার্জশিট হচ্ছে। একজন উপাচার্যও যে অন্যায় করলে আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেটাই এখন প্রমাণের সময় এসেছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-সংকট রয়েছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও কম নয়। শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বইয়েরও অভাব; প্রযুক্তিসেবা থেকেও পিছিয়ে। এসব অভাব যতদ্রুত সম্ভব দূর করা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক আগ্রহে ১০ তলাবিশিষ্ট একটি ছাত্রীহলের কাজ শুরু হচ্ছে। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার নামে ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের ১০ তলা আরো একটি ভবন হচ্ছে।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও ২০০৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কিংবদন্তি লেখক-সংগঠক-নারীমুক্তির অগ্রপথিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামে করা হয়। ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় নয় বছরে পদার্পণ করছে। সংকট থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালয় আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর যৌথ চেষ্টা সে জন্য খুবই জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।