স্মরণ
প্রিয় লাডু ভাই আর ফিরে আসেননি
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়া সংগঠক শেখ আবদুল মান্নান ওরফে লাডু ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। চিরতরে হারিয়ে যান সদা হাস্যোজ্জ্বল, সবার প্রিয় লাডু ভাই। তাঁর লাশের খোঁজে মিরপুর, রায়েরবাজারসহ অনেক জায়গায় হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তাঁর ছোট ভাই এস এ আব্বাস। কিন্তু কোথাও মেলেনি প্রিয় বড় ভাইয়ের সন্ধান। তবু ভাইয়ের খবর একদিন পাবেন, এমন আশাতেই দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ বিমানের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা। বার্ধক্যে এসেও যেন সেই আশা আর শোক শেষ হচ্ছে না ছোট ভাই আব্বাসের!
আবদুল মান্নান ভাই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করলেও তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন বাঙালি জাতি একদিন বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আর বাঙালির মুক্তির কথা ভাবতেন তিনি।
পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় বাবা-মায়ের কাছে অনেক বেশি আদরের পাত্র ছিলেন আবদুল মান্নান। বিয়ে করেননি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। মাকেও ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। একাত্তর সালের ১৪ ডিসেম্বরে আবদুল মান্নানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ছেলের আত্মার শান্তি কামনায় বাড়িতে মিলাদ মাহফিল করতেন মা। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আনুমানিক সাড়ে ৭টার পর আবদুল মান্নানের মা মারা যান মিলাদ মাহফিল চলাকালেই। ছেলের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া করতে করতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঠিক এমন সময়েই আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল হানাদারেরা।
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছোট ভাই আব্বাস। বললেন, ‘মা হয়তো হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সন্তানের ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন!’ আবদুল মান্নানের পরিবারের আক্ষেপ, কেউ মনে রাখেনি শহীদ এই বুদ্ধিজীবীকে। তাই বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এস এ আব্বাস বলেন, ‘বেশি কিছু চাইনি আমরা! চেয়েছিলাম আমার ভাইকে একটু সম্মান দেখাবে রাষ্ট্র। এই সম্মান আমার ভাইয়ের প্রতি রাষ্ট্রের করুণা নয়, এটা শহীদ লাডু ভাইদের অধিকার। রাষ্ট্র কি পারে না এই মানুষগুলোকে সম্মানিত করতে? তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে? যাঁরা আমৃত্যু মুক্তির স্বপ্ন লালন করতেন।’
কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে এস এ আব্বাসের। তাঁর চোখ থেকে তখনো বেদনার জল গড়িয়ে পড়ছে। আর অপলক দৃষ্টি আটকে রইল দেয়ালে টাঙানো হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সাদা-কালো ছবিটির দিকে।