কোরবানি ও মাথা মুণ্ডনের মধ্যে শেষ হলো হজের তৃতীয় আনুষ্ঠানিকতা
পশু কোরবানি ও মাথা মুণ্ডনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো পবিত্র হজের তৃতীয় আনুষ্ঠানিকতা। হজের তৃতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে মক্কা থেকে পূর্বে মিনায় জমায়েত হন হাজিরা। মিনায় তিন জামারাতে হাজিরা শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করেন। পরে পশু কোরবানি ও চুল কাটার মধ্য দিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে শেষ হয় হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এরপর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত শেষে আবার মিনায় ফিরে আসেন হাজিরা। পর্যায়ক্রমে আরও তিন দিন মিনায় অবস্থান করে শয়তানকে তিনটি পাথর নিক্ষেপ করবেন আগত হাজিরা।
এর আগে গত রোববার থেকে মিনায় হাজিদের অবস্থানের মাধ্যমে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সোমবার মিনা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে আরাফাতের ময়দানে হাজির হন তাঁরা। সেখানে হজের খুতবার সঙ্গে জোহর ও আসরের নামাজ একত্রে জামাতে আদায় করেন তাঁরা। সারা দিন আরাফাতে ইবাদতে কাটানোর পর সন্ধ্যায় তাঁরা আরাফাত ও মিনার মাঝামাঝি মুজদালিফায় গিয়ে রাত্রিযাপন করেন। সেখানে তাঁরা একত্রে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এ বছর শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য আগেই জীবাণুমুক্ত করা নুড়িপাথর সরবরাহ করা হয়।
এ বছর মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববীতে ঈদের নামাজের ইমামতিতে ছিলেন যথাক্রমে ড. শেখ বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা ও শেখ আলী ইবনে আবদুর রহমান আল-হুজাইফি।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৫ মিনিটে মসজিদুল হারামে ঈদুল আজহার নামাজ পড়ান শেখ বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা।
অপরদিকে, মসজিদে নববীতে স্থানীয় সময় ৫টা ৫৮ মিনিটে নামাজ শুরু করেন শেখ আলী ইবনে আবদুর রহমান আল-হুজাইফি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে সতর্কতায় এই বছর করোনা প্রতিরোধী টিকা নেওয়া মাত্র ৬০ হাজার আবেদনকারী হজের অনুমতি পেয়েছেন। সৌদি আরবের বাইরে থেকে এই বছরও কোনো আবেদনকারীকে হজে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। শুধু ১৫-৬৫ বছর বয়সী সৌদি নাগরিক ও দেশটিতে বাস করা ১৫০ দেশের নাগরিক হজ করার সুযোগ পেয়েছেন। গতকাল দ্বিতীয় দিনে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কার পাহাড় ঘেরা আরাফাতের ময়দানে হজ করতে জড়ো হন ৬০ হাজার মুসল্লি। করোনা মহামারির মধ্যে এটা দ্বিতীয় হজ। তাই সীমিত পরিসরে কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালিত হচ্ছে এবারের হজ।
একনজরে হজের ৫ দিন
৮ জিলহজ : হজের ইহরাম
মক্কার হারাম শরিফ বা বাসা/হোটেল থেকে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া এবং জোহরের নামাজের আগেই মিনায় পৌঁছা। মিনায় ৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব এবং সেখানে অবস্থান করা সুন্নাত।
৯ জিলহজ : আরাফাতের ময়দানে অবস্থান
৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন হাজিরা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফাই হজ’। তাই ৯ জিলহজ ফজরের পর সম্ভব হলে মিনায় গোসল করে নেবে অথবা ওজু করে সকাল সকাল আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওনা হওয়া।
৯ জিলহজ জোহরের আগেই হজের অন্যতম রোকন পালনে আরাফাতের ময়দানে গিয়ে উপস্থিত হওয়া এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করা। আর এটাই হলো হজের অন্যতম রোকন। ৯ জিলহজ সকালে মিনা থেকে রওনা হওয়ার সময় তাকবির বলা- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে হজের খুতবা শোনা। জোহর নামাজের ওয়াক্তে এবার আরাফাতের ময়দানের মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দিয়েছেন কাবার ইমাম ও খতিব শেখ বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা। মোনাজাত করেছেন করোনা মহামারি থেকে মুক্তি ও বিশ্ব শান্তির জন্য। মসজিদে নামিরায় হাজিরা জোহর ও আছরের নামাজও আদায় করেন। তাওবা-ইসতেগফার, তাকবির, তাসবিহ, তাহলিল ও রোনাজারিতে আত্মনিয়োগ করা। বিশেষ করে, হজের খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তা বুঝে নিয়ে জীবনের বাকি সময় এ নসিহতের আলোকে জীবন গড়ার দীপ্ত শপথ নেওয়া। সন্ধ্যায় মাগরিব না পড়ে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হওয়া। মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও ইশার নামাজ এক আজানে আলাদা আলাদা ইকামতে একসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আদায় করা।
১০ জিলহজ
মুজদালিফায় অবস্থান : মুজদালিফায় সারা রাত খোলা আকাশের নিচে মরুভূমির বালুর ওপর অবস্থান করা। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্য উঠার আগে কিছু সময় অবস্থান করা এবং সূর্য উঠার আগেই মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া।
পাথর সংগ্রহ : মিনায় জামারাতে (শয়তানকে পাথর মারার তিনটি স্তম্ভ) মুজদালিফায় অবস্থানের সময় রাতে কিংবা সকালে পাথর সংগ্রহ করা। ১০ জিলহজ সকালে মুজদালিফা থেকে মিনায় এসেই বড় জামারাতে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করা। আর তা জোহরের আগেই সম্পন্ন করা। পাথর নিক্ষেপের স্থানগুলোতে বাংলায় দেওয়া দিক-নির্দেশনা মনোযোগ সহকারে শুনে তা আদায় করা।
কোরবানি করা : বড় জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করেই মিনায় কোরবানির পশু জবাই করা। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যাংকের মাধ্যমে কোরবানি সম্পন্ন করবেন, তারা ব্যাংকের লোকদের কাছ থেকে মাথা ন্যাড়া বা হলক করার নির্দিষ্ট সময় জেনে নেওয়া।
মাথা মুণ্ডন করা : কোরবানির পর পরই মাথা ন্যাড়া করার মাধ্যমে হজের ইহরাম থেকে হালাল হবে হাজি। মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে হাজি ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করাসহ সব সাধারণ কাজ করতে পারলেও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।
১১ ও ১২ জিলহজ
তাওয়াফে জিয়ারত : হজের সর্বশেষ রোকন হলো তাওয়াফে জিয়ারত। যা ১১ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগে তাওয়াফে জিয়ারত না করতে পারলে দম বা কোরবানির কাফফারা আদায় করতে হবে।
পাথর নিক্ষেপ : ১১ ও ১২ জিলহজ প্রতিদিন মিনায় অবস্থান করবে এবং ধারাবাহিকভাবে ছোট, মধ্যম ও বড় জামারাতে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবে। তবে যদি কেউ পাথর নিক্ষেপের আগে কিংবা পরে কাবা শরিফ গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করে তবে তাকে তাওয়াফের পর আবার মদিনায় চলে আসতে হবে এবং মিনায় অবস্থান করতে হবে।
মিনায় রাত যাপন ও ত্যাগ : ১০ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত মিনাতেই রাত যাপন করা এবং যারা মিনা ত্যাগ করবেন তারা ১২ তারিখ সূর্য ডোবার আগেই মিনা ত্যাগ করবে। সূর্য ডোবার আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে সে রাত (১৩ জিলহজ) মিনায় অবস্থান করা।
উল্লেখ্য যে, যদি কেউ ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারে কিংবা থাকার ইচ্ছা করে তাকে ১৩ জিলহজ সাতটি করে আরও ২১টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১৩ জিলহজও মিনায় অবস্থান করেছিলেন।
বিদায়ী তাওয়াফ
সারা বিশ্ব থেকে আগত সব হজপালনকারীর জন্য দেশে রওনা হওয়ার আগে তাওয়াফ করা আবশ্যক। এ তাওয়াফকে বিদায়ী তাওয়াফ বলে। তবে জিলহজ মাসের ১২ তারিখের পর যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে হিসেবে আদায় হয়ে যায়।