দুর্গাপূজার আচার-আনুষ্ঠানিকতা : কোন দিন কীভাবে পালিত হয়
শারদীয় দুর্গাপূজা এখন শুধু ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরেও সকল মানুষের মিলনমেলায় একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় মূলত ষষ্ঠীর দিন থেকে। ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত এই পাঁচ দিনে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা সর্বোচ্চ আচার-আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন করা হয়।
তবে চৈত্র মাসেও দুর্গাপূজা হয়, যেটি বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত এবং এর জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গাষষ্ঠী’, ‘মহাসপ্তমী’, ‘মহাষ্টমী’, ‘মহানবমী’ ও ‘বিজয়া দশমী’ নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। এই দিন ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
কোথাও কোথাও ১৫ দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে।
তিন প্রকারের দুর্গাপূজা : কোনটি কেমন?
১. সাত্ত্বিক (জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দ্বারা পূজা), ২.তামসিক (কিরাতদের জন্য বিহিত; এতে জপ, যজ্ঞ ও মন্ত্র নেই; মদ্য, মাংস প্রভৃতি দ্বারা পূজা করা হয়) ও ৩. রাজসিক (পশুবলি ও আমিষ ভোগ দ্বারা পূজা করা হয়)।
অতীতে দুর্গাপূজার সময় ছাগল, মেষ, মহিষ, হরিণ, শূকর, গন্ডার, বাঘ, গোসাপ, কচ্ছপ বা পাখি বলি দেওয়া হতো। কোনো কোনো গ্রন্থে নরবলির বিধানও আছে। বর্তমানে অবশ্য বলির প্রচলন নেই বললেই চলে। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে কোনো কোনো পারিবারিক পূজায় এখনও পাঠা বলির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
ষষ্ঠীতে বোধন
দুর্গাপূজা শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন থেকে। মনে করা হয়, শরৎকালে দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন রাম। রাবণকে পরাজিত করার জন্য দশভূজার আশীর্বাদের কামনায় তিনিই এ সময় দুর্গাপূজা করেন। বোধনের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আবাহন করা হয়। ষষ্ঠীর দিনে এ ছাড়াও আরও অন্যান্য অনেক নিয়ম-আচার পালিত হয় ও সকলকে রীতিনীতি মেনে দুর্গার আরাধনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান
নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ। নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই রীতি বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের শিকড়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। সপ্তমীর দিন এই রীতি পালিত হয়। এ দিন একটি ছোট কলাগাছের সঙ্গে আরও আটটি গাছের পাতা বেঁধে তা স্নান করানো হয়। এগুলোর মধ্যে কলাগাছটিই স্পষ্টভাবে দেখা যায় বলে এই নিয়মকে অনেকে কলাবউ স্নানও বলে। নয়টি গাছের পাতা শক্তির নয়টি রূপকে তুলে ধরে। যেমন— ব্রহ্মাণী (কলা), কালিকা (কচু), দুর্গা (হলুদ), কার্ত্তিকী (জয়ন্তী), শিব (কৎবেল), রক্তদন্তিকা (বেদানা), শোকরহিতা (অশোক), চামুণ্ডা (ঘটকচু), লক্ষ্মী (ধান)। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’নামে পূজিতা হন। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নানের জন্য নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তার পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। এর পর লাল পাড় ও সাদা শাড়িতে মুড়িয়ে পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে গণেশের পাশে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলোতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের আগে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।
দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল মহাস্নান। মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নানের পর মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে স্নান করানো হয়। মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছিটানো জল, ফুল দিয়ে ছিটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিলের তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানো হয়।
মহাস্নানের প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে স্বামী ত্যাগিবরানন্দ বলেছেন, “এই সকল ক্রিয়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণিজসম্পদ, ভূমিসম্পদ প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে। এমনকি চাষাভূষা, মুচি-মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, মালি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করে। এককথায় সার্বিক সমাজলক্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।”
অষ্টমীতে অঞ্জলি
পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে দুর্গার প্রতি নিজের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন ভক্তরা। সাধারণত সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিনদিনই পুষ্পাঞ্জলি হয়। তবে অষ্টমীর অঞ্জলিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের পর হাতে ধরে থাকা ফুল-পাতা মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার চরণে অর্পণ করার রেওয়াজ রয়েছে।
মহালয়া বা পিতৃপক্ষের দিন থেকে মূলত দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও এ দিনটির তাৎপর্য মূলত ভিন্ন। এ তিথিকে পিতৃপক্ষও বলা হয়ে থাকে। এ দিনে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু হয়। এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন, তারা তাদের পূর্বপুরুষকে স্মরণ করে, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে, এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য, তারা শুধু পূর্বপুরুষদের নয়; পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করে থাকেন।
অষ্টমী পূজা হলো দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অষ্টমীর দিনে অনেক মানুষ পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দেবী দুর্গাকে নিজের মনের ইচ্ছা জানায়। এই দিন চামুণ্ডারূপে দেবী দুর্গাকে পূজা করা হয়। এই দিন বিভিন্ন মন্দিরে চালকুমড়ো, চিনি প্রভৃতি বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। এই দিন অষ্টমীর সন্ধিপূজার সময় ৬৪ ডাকিনী যোগিনীর পূজা করা হয়। এই দিন বেশিরভাগ মন্দিরে দেবী দুর্গাকে লুচি সুজির ভোগ দেওয়া হয়। এই মহাঅষ্টমী হল দুর্গাপূজার মধ্যে একটি অন্যতম সেরা দিন।
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারীপূজার প্রচলন রয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে আছে দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বেলগাছে দেবীর বোধন করতে নির্দেশ দেন।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে কুমারীপূজার প্রবর্তন করেন। রঘুনন্দন প্রণীত তত্ত্ব অনুসারেই পূজা সম্পন্ন হয়। সারদা দেবীর নামে সংকল্প হয়। পশুবলির ব্যবস্থা করা হলেও তা হয়নি।
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে বিভিন্ন নামে পূজা করা হয়। এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরে সরস্বতী, তিন বছরে ত্রিধামূর্তি, চার বছরে কালিকা, পাঁচ বছরে সুভগা, ছয় বছরে উমা, সাত বছরে মালিনী, আট বছরে কুঞ্জিকা, নয় বছরে কালসন্দর্ভা, দশ বছরে অপরাজিতা, এগারো বছরে রুদ্রাণী, বারো বছরে ভৈরবী, তেরো বছরে মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরে পঠিনায়িকা, পনেরো বছরে ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোলো বছরে অম্বিকা নামে অভিহিতা হয়।
তন্ত্রশাস্ত্র মতে, কন্যা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত তারা এইসব নামে পূজিত হবে। একটি কুমারী কন্যাকে খাওয়ালে বিশ্বভুবনকে খাওয়ানো হয় বলেও শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।
সন্ধিপূজা : দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধিপূজা। দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন হয় এই বিশেষ পূজা, এই পূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগস্থলে এই পূজা হয়, তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা বা সন্ধিকালিন পূজা। এই পূজা দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। এইসময় দেবী দুর্গাকে চামুণ্ডারূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়।
অপরাজিতা পূজা দুর্গাপূজার একটি অঙ্গ। দুর্গার অপর নাম অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। ইনি চতুর্ভূজা; হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা; গায়ের রং নীল; ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা। বিজয়াদশমীর দিন বিসর্জনের পর পূজামণ্ডপের ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে এই দেবীর পূজা করা হয়। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, ইনি ‘বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া লক্ষ্মী ও শিবশক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা।’
মহানবমী
শারদীয় দুর্গোৎসবের চতুর্থ দিন মহানবমী। নবমী তিথিতে পালন করা হয় কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। শাস্ত্র মতে, রামায়ণ যুগের অবতার শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা অধিপতি রাবণ বধের পর নবমী তিথিতে দুর্গার পূজা করেছিলেন ১০৮টি নীলপদ্মে। তাই দুর্গোৎসবের মহানবমীতে ষোড়শ উপাচারের সঙ্গে ১০৮টি নীলপদ্মে পূজিত হন দেবী দুর্গা। এদিন নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় নবমী বিহিত পূজা। নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়।
মহাঅষ্টমীতে কুমারী পূজার পর নবমী সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হয় সন্ধিপূজা। মহিষাসুর নিধনের সময় দেবী দুর্গা প্রচণ্ড ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করেছিলেন। তাই পূজার এই আচারের সময় দেবীকে চামুণ্ডারূপে পূজা করা হয় অর্থাৎ যিনি চণ্ড ও মুণ্ডের বিনাশিনী। নানা আচারের মধ্য দিয়ে মহানবমীর পূজা শেষে যথারীতি থাকে অঞ্জলি নিবেদন ও প্রসাদ বিতরণ।
নবমীর সকাল মানে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি। শারদীয় দুর্গা উৎসবের নবমীর এই দিনটিতে দেবী দুর্গা অসুরকে বধ করেছিলেন। শ্রী রামচন্দ্র দুর্গার শক্তি আর আশীর্বাদ নিয়ে এই দিনে অশুভ রাবণকে বিনাশ করেছিলেন বলে একে অকাল বোধন বলা হয়। শাস্ত্র মতে, মহানবমীর দিনে নিজের মনোবাসনা জানিয়ে যজ্ঞে আহুতি প্রদান করলে ধন ও যশ প্রাপ্তি ঘটে।
বিজয়া দশমী
বিজয়া দশমীর দুটি তাৎপর্য। একটি দেবী দুর্গার বিজয়। অপরটি শ্রী রামচন্দ্রের বিজয়। বিজয়া দশমীর আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। হিমালয় রাজকন্যা দেবী দুর্গা বা পার্বতী কিংবা উমা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন দেবতা শিবকে। শিবের আবাসস্থল কৈলাস পর্বত। সেখান থেকে দেবী দুর্গা বা পার্বতী পিতৃগৃহে আসেন আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন পিত্রালয়ে থাকার পর দশমী তিথিতে পতিগৃহ কৈলাসে প্রত্যাবর্তন করেন। কন্যাকে বিদায় জানানোর বেদনায় বিধুর-বিষাদাচ্ছন্ন হয় দশমী তিথি। তাই দশমী তিথি বিষাদের-বেদনার। এভাবে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। যে কি না নাইওরে এসে, তিন দিন থেকে চার দিনের দিন স্বামীগৃহে ফিরে যান। এভাবে দুর্গাপূজার মধ্যে বাঙালির সমাজ ও যাপিত জীবনের প্রতিফলন ঘটে।
আবার ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ রামের স্ত্রী সীতা দেবীকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। রাবণকে পরাজিত করে রামচন্দ্র পালন করেন বিজয় উৎসব। এ থেকেও পালিত হয় বিজয়া। আবার মহিষাসুরকে বধ করতে দেবীর যে যুদ্ধ হয়েছিল, তার মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল চার দিন। তিথির হিসেবে সেগুলো ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। এ শুক্লা দশমী তিথিতে বিজয় হয়েছিল বলে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিকেই বলা হয় বিজয়া দশমী। দুর্গাপূজার চার দিনের দিন দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বিজয়া দশমী পালন করা হয়। বাংলাদেশে বিজয়া দশমীতে সর্বসাধারণের জন্য এদিন সরকারি ছুটি থাকে।
মূলত নবমীর দিনই পূজার শেষ হয়। তবে বিজয়া দশমীর দিনেও বেশকিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে। বিজয়া দশমীতে দুর্গাদেবীর দশমী বিহিত পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন অনুষ্ঠিত হয়। এদিনই প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শারদীয় দুর্গোৎসব।
লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
তথ্যসূত্র
১. পূজাবিজ্ঞান, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
২. মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।
৩. পুরোহিত দর্পণ, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, সত্যনারায়ণ লাইব্রেরি, কলকাতা।
৪. পূজা-পার্বণ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
৫. হিন্দুদের দেবদেবী, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য ,ফার্মা কেএলএম প্রা.লি., কলকাতা।
৬. সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা।