‘শুধু নারী দিবসে নয়, প্রতিদিন নারীকে সম্মান করুন’
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের অধিকার আন্দোলনের স্মরণে প্রতিবছর এই দিনে নারী দিবস পালন করা হয়। নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি সর্বস্তরে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করা হয়। তবে শুধু নারী দিবসেই নয়, প্রতিদিনই নারীকে সম্মান জানানোর আহ্বান জানালেন বাংলাদেশের স্বর্ণজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। একই বার্তা দিলেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটার ফাহিমা খাতুন ও মোহামেডানের নারী পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত (ভারোত্তোলক)
এই সময়ে আমরা মেয়েরা অনেক স্বাধীন। আমরা এখন চাইলেই নিজেদের ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারছি। আমাদের পরিবারও আমাদের ইচ্ছাগুলোর প্রাধান্য দিচ্ছে। আমরা মেয়েরা বিভিন্ন বিভাগে ভালো ফল আনছি, উচ্চপর্যায়ে কাজ করছি। তবে মাঝে মধ্যে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটে এসব ঘটনার জন্য আমি বলব, কিছু ভুল আমাদেরও আছে, কিছু ভুল আমাদের পরিবারের আছে, আর যারা করছে তাদেরও আছেই। এখন স্বাধীনতার চেয়ে, দেখতে হবে আমরা কতটা নিরাপদ। রাস্তায় বের হলে একটা মেয়ে কতটা নিরাপদ সেটা আগে দেখা উচিত এবং সেটা আমারদেরই তৈরি করতে হবে। এ জন্য সবার মানসিকতার পরিবর্তন আনা উচিত।
মেয়েদের এগিয়ে যেতে হলে আমি বলব, প্রতিটি মেয়েকে নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে নিজের চেষ্টা করতে হবে, মনোবল থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলব আমাদের আশপাশের জায়গাও ঠিক হতে হবে। সেটা বাবার বাড়ি হোক, আর স্বামীর বাড়ি হোক। পরিবার যদি সাহায্য না করে, তাহলে আমরা নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব না।
নারী দিবসের কথা বললে, আমি মনে করি ওই একটা দিনই নারীদের জন্য না। প্রতিদিনই নারী দিবস। প্রতিদিনই নারীদের সম্মান করা উচিত। একদিন সম্মান করব, বাকি ৩৬৪টি দিন নারীদের সেভাবে সম্মানের চোখে দেখব না— সেটা তো কাম্য নয়। তবে হ্যাঁ, আনুষ্ঠানিক একটি দিন থাকা উচিত, তবে প্রতিদিনই নারীদের সম্মান করুন। আমরা কখনও ভাবব না নারী অযোগ্য, সে পারবে না। এসব না ভেবে নারীকে প্রতিটি দিন ভালোবাসুন ও শ্রদ্ধা করুন।
ফাহিমা খাতুন (ক্রিকেটার)
একজন নারীর স্বাধীনতা শুরু হয় তাঁর পরিবার থেকে। আমি যেটা মনে করি, যে আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, কিন্তু পরিবারের সাপোর্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজ এখনও মেয়েদের বাইরে বলেন, জব করা বা খেলাধুলা করা এসব অনেকে এখনও নিতে পারে না। তো এখানে পরিবারের সমর্থন থাকলে মেয়েদের চলার পথটা মসৃণ হবে। মেয়েদের চলার পথের শুরুটা একটু কঠিন হতে পারে। কিন্তু, সাফল্য এলে সবাই শ্রদ্ধা করবে। আমার কথাই বলি—আমি এখন অনেক ফ্রি। সবাই শ্রদ্ধা করে। বাড়িতে গেলে সবাই সম্মান জানায়। এলাকার সবাই এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়।
একটা মেয়েকে স্বাধীন হতে অবশ্যই তাঁকে আগে শিক্ষিত হতে হবে। আমিও খেলার পাশাপাশি লেখাপড়া করেছি। কাজের পাশাপাশি উচিত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। সব মেয়েকে বলব, যেকোনো ভালো জায়গায় যেতে হলে অবশ্যই ভালো শিক্ষা লাগবে। পড়াশোনা তার ভালো জায়গায় যাওয়ার পথ খুলে দেবে। তাকে লড়াই করার শক্তি দেবে। আর আলাদা কোনো ট্যালেন্ট থাকলে অবশ্যই উচিত সেটাকে কাজে লাগানো। প্রতিবন্ধকতা আসবেই, সেগুলো পার করে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। যার ট্যালেন্ট আছে তাদের উচিত সেই ট্যালেন্টকে প্রাধান্য দেওয়াতে হবে। নিজের স্কিলকে তাঁর কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই মেয়েরা পারবে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে। আর সবার উচিত নারীদের সম্মান করা।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন (মোহামেডানের পরিচালক)
আমাদের সমাজের নারীরা মনে করেন—আমি নারী, আমি এটা পারব না। আমি মনে করি—আমি একজন মানুষ, একজন পুরুষ পারলে আমি কেন পারব না। আমার আগের কর্মক্ষেত্রেও আমি পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে ছিলাম, পরিচালক হয়েছি। আমি পড়াশোনার জগতেও সবসময় আমি প্রতিযোগিতা করেছি। তাই, আমি নারী হিসেবে নিজেকে ছোট ভাবি না। সব নারীদেরও তাই মনে করা উচিত। আমাদের সমাজের কিছু পুরুষ হয়তো নারীদের ছোট ভাবে। সেই সংখ্যাটাও এখন অনেক কম। হয়তো পরবর্তী প্রজন্মে সেটা থাকবেও না। এই নারীকে পিছিয়ে ফেলে দেশকে নিয়ে এগোনো যায় না। আর এই সময়ে নারীকে আমাদের সমাজের মানুষ সম্মান করা শিখেছে। নারীদেরও উচিত নিজের মেধাকে কাজে লাগানো।
আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েরা অনেক সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু সেভাবে তাদের উৎসাহ দেওয়া হয় না। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জায়গায় আমাদের আরেকটু যত্নবান হতে হবে। আর, খেলা শুধু শরীরের জন্য ভালো তা কিন্তু নয়, খেলা মন ভালো রাখার উপাদান। যারা খেলাধুলা করে তারা জীবনের প্রতিটি জায়গায় সাফল্য পায়। আমি নিজের কথা যদি বলি—আমাদের পরিবার থেকে ছোট থেকে খেলার জন্য তাগিদ দিত। যেটা আমাকে এই অবস্থায় আসতে সাহায্য করেছে। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। অনেকে মনে করে মেয়েরা লাজুক, সব কাজ পারবে না। সেটা কিন্তু নয়। দেখুন, মেয়েরা কারখানায় কাজ করছে, ইট ভাঙছে, গাড়ি চালাচ্ছে, আবার রাষ্ট্রের বড় বড় জায়গাও কাজ করছে। মেয়েরা কঠিন কঠিন কাজ করছে। বিভিন্ন সাফল্য এনে দিচ্ছে। মেয়েরা সবকাজ করতে পারে। সুতরাং মেয়েরা যে পারদর্শী, সেটা তারা এরই মধ্যে দেখিয়েও দিয়েছে। কিন্তু, তাদের নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না, উৎসাহ দেওয়া হয় না। আমি বলব, মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত। উৎসাহ পেলেই নারীরা এগিয়ে যাবে।