বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথা!
এ মুহূর্তে ক্রিকেট-বিশ্ব দেখছে এক অবিস্মরণীয় উত্থানের গল্প। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেন একের পর এক লিখে চলেছে দারুণ রোমাঞ্চকর রূপকথা। মাত্র কয়েক দিন আগেও যাদের বিবেচনা করা হতো ক্রিকেট অঙ্গনের ‘বাচ্চা’ অথবা ‘ছোটভাই’, তাদের প্রতাপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ‘বড়’দের দম্ভ-গরিমা।
জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারতের পর ষষ্ঠ টেস্ট দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা পেল বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারের স্বাদ। ‘বাংলাওয়াশে’র তিক্ত স্বাদও পেয়েছে প্রথম চারটি দল। বাংলাদেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে, ক্রিকেট-বিশ্বে তাদের সমীহ করেই চলতে হবে। তাদের নিয়ে কটূক্তি-দম্ভোক্তির দিন শেষ।
গত বছরের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ যেন উড়ছে। বাধা মানছে না কোনো কিছুতেই। কোনো আসরেই। জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে শুরু হয়েছিল মাশরাফিদের স্বপ্নযাত্রা, যা এখনো থামেনি...। কখনো যেন না থামে—সে প্রত্যাশা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমীরই। গত নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ ২০টি ওয়ানডে খেলেছে। জিতেছে ১৫টি। হেরেছে মাত্র পাঁচটি, যার একটি আবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে। বিতর্কিত আম্পায়ারিং আর ভারতীয় প্রচারাধিপত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব যে সেই হারের সঙ্গী, তা হয়তো এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার স্বপ্নপূরণের কয়েক মাস আগে থেকে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের চমক-জাগানো উত্থান। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল মাশরাফির দল। বিশ্বকাপের পর জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে পাকিস্তানকেও হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডুবিয়ে।
অনেক শোরগোল তুলে, মাশরাফিদের বাঁকা চোখে দেখার ঔদ্ধত্য দেখালেও পূর্ণশক্তির ‘টিম ইন্ডিয়া’ও নতজানু হয় বাংলাদেশের পরাক্রমের কাছে। পাকিস্তানের পর ভারতের বিপক্ষেও বাংলাদেশ পায় প্রথমবারের মতো সিরিজ জয়ের মধুর অভিজ্ঞতা। প্রথম দুই ম্যাচ জিতেই সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলে মাশরাফির দল। সিরিজের শেষ ম্যাচ জিতে ভারত একটা সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছিল। তাই ঘরের মাঠে টানা ১০ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর বাংলাদেশকে হারের তেতো স্বাদ পেতে হয়েছে।
পাকিস্তান-ভারতের পর প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। পেশাদারিত্ব ও ধারাবাহিকতার বিচারে ক্রিকেট-বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি প্রোটিয়াদের বিপক্ষে বাংলাদেশ কেমন করে, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। দুটি টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ায় কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন। কিন্তু ঘরের মাটিতে এখন বাংলাদেশের হারই যে অপ্রত্যাশিত, সেটা মাশরাফি-সাকিবরা দেখালেন দ্বিতীয় ওয়ানডে দাপটের সঙ্গে জিতে। তাই গণমাধ্যমের শিরোনাম, ‘স্বরূপে বাংলাদেশ’!
সৌম্য সরকারের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ে ৭ উইকেটের জয় দিয়ে সিরিজে সমতা ফেরায় লাল-সবুজের দল। সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে আরো ভালো করে চেনায় তাদের বদলে যাওয়া রূপ। ব্যাটে-বলে সমান দাপট দেখিয়ে জিতে নেয় ৯ উইকেটে।
ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো ১০ উইকেটে জয় পেয়ে আরেকটি ইতিহাস গড়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তা হয়নি জয় থেকে মাত্র ১৬ রান দূরে থাকতে ৭৫ বলে ৯০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন ‘সেনসেশন’ সৌম্য আউট হয়ে যাওয়ায়।
এর আগে বাংলাদেশের ৯ উইকেটের জয় ছিল মাত্র দুটি। সে দুটিও অনেক দিন আগে, ২০০৬ সালে কেনিয়া আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আমলা-ডুমিনি-ডু প্লেসি-তাহির সমৃদ্ধ প্রোটিয়াদের ৯ উইকেটে বিধ্বস্ত করা যেন আরেকটি ক্রিকেট-রূপকথা।
অনেক প্রাপ্তির এই ম্যাচে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বোলার হিসেবে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মুর্তজা। তামিম আর সৌম্য গড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে যেকোনো উইকেটে রেকর্ড ১৫৪ রানের জুটি। সৌম্য-সাব্বির-মুস্তাফিজদের মতো আগামীর তারকারা যে কতটা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করেছেন, তা অবশ্য কোনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যাবে না।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দাপটের সামনে মাথা নোয়াতে হয়েছে ছয়টি টেস্ট দলকে। এখন বাকি শুধু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। এই তিন দলকে ওয়ানডে সিরিজে হারাতে পারলেই সাফল্যের বৃত্ত পূর্ণ হবে।
সেদিন আর বেশি দূরে নেই নিশ্চয়ই!