ক্রিকেটের ‘জেন্টলম্যান’ কুমার সাঙ্গাকারা
শ্রীলঙ্কার পি সারা ওভালে টানা ১৫ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ইতি টানলেন কুমার সাঙ্গাকারা। বিদায়বেলায় তাঁকে সম্মান জানাতে মাঠে ছুটে গেলেন লঙ্কান প্রেসিডেন্টও। একজন ক্রিকেটার কত বড় মাপের হলে তাঁর জন্য খোদ প্রেসিডেন্ট ছুটে যান মাঠে। শ্রীলঙ্কার জার্সি গায়ে দেওয়াটাকে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচয়ে বড় পাওয়া মনে করেন সাঙ্গাকারা। যার নামের আগে ‘ভদ্রলোক’ খেতাবটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রিকেটের সত্যিকারের ভদ্রলোক যে তিনি ছিলেন, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আমি হাতেনাতে।
সালটা ২০০৭। মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা সফর করছে। ক্যান্ডিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে হাঁকালেন ব্যাক টু ব্যাক হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু তাঁর ২২২ রানের ইনিংসটা ছাপিয়ে গেল মুরলি ধরনের ৭০০ উইকেটের বিশ্বরেকর্ডকে। খেলা শেষে সবাই ব্যস্ত হয়ে যখন মুরলি নিয়ে, আমিও তার ব্যতিক্রম হলাম না। কিন্তু এই ফাঁকে মিস করে বসলাম সাঙ্গাকার ডাবল হানড্রেডের বাইট।
কী করি অফিসকে তো আর এটা বোঝানো যাবে না। তাই সন্ধ্যার পর রওনা হলাম টিম হোটেলে। গিয়ে দেখি শ্বশুরবাড়ির লোকদের নিয়ে সেঞ্চুরি উদযাপন করছেন রাতের খাবারের টেবিলে। এমন অবস্থায় কী করে বলি আমার একটা বাইট লাগবে তাঁর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সাহস করে বলে বসলাম ২০ সেকেন্ড সময় দেওয়ার জন্য। প্রথমে না করলেও; পরে রাজি হয়েছেন এবং প্রায় সাত মিনিট কথা বলেছেন। যদি তিনি ভদ্রলোক না হবেন তবে কেন আমাকে ওই অবস্থায় খাবার টেবিল থেকে উঠে আলাদা করে বাইট দেবেন; যে পর্বটা তিনি বিকেলেই শেষ করে এসেছেন।
ওই দিন তাঁর আচরণে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
ব্যক্তিগত জীবনে খুবই অমায়িক একজন মানুষ। শ্রীলঙ্কা দলে অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও অরবিন্দ-ডি-সিলভার মধ্য যেমন একটা শীতল সম্পর্ক ছিল তেমনি মাহেলা আর সাঙ্গাকারা মধ্য তা ছিল। কিন্তু মাঠে তা বোঝা যেত না। নিজেকে সম্পূর্ণ ফিট রাখার জন্য বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। একদিন তাঁকে টিম হোটেলে পেলাম বেশ ভালো মুডে। আমরা তখন ওই সফরে তাজ সমুদ্র টিম হোটেলে থাকতাম। এমনি এক বিকেলে তাঁকে সুইমিংপুলে পেলাম। সুইমিং শেষে আড্ডা দিচ্ছিলেন। কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করলাম। দেখলাম বেশ ভালো মুডেই উত্তর দিচ্ছেন। জানতে চাইলাম বাংলাদেশে ক্রিকেটারের বর্তমান অবস্থা। কোনো পেশাদার ক্রিকেটার অন্য দল সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেন না। সাঙ্গাও তাই। তবে তিনি যা বলছিলেন, তা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারররা যে কতটা মেধাবী তারা বোধ হয় নিজেরাও জানে না। তবে তারা মেধার সদ্ব্যবহার করতে পারলে বদলে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের চেহারা। এ ছাড়া নেট প্র্যাকটিসে তাদের ব্যাট করতে হবে ম্যাচ মনে করে। কোনোভাবেই আউট হওয়া যাবে না।’ আপনি দেখবেন এই প্র্যাকটিস যেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা রপ্ত করতে পারবে, সেদিন তারা অন্য দলে পরিণত হবে।’ হোটেল লবিতে তুষার ইমরানকে বলেছিলাম ওর সঙ্গে কথা বলতে, নিজের ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতে। ওকেও নেটে আউট না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। ২০০৭ সালে সাঙ্গাকারা যে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটার এখন তা মেনে চলেন।
একজন ক্রিকেটার কীভাবে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের টেস্টে ডাবল হানড্রেড করেন; সেটাও দেখেছি সাঙ্গাকারাকে।
ওই সফরে প্রথম টেস্টে সিংহলি মাঠে সাঙ্গাকারা সৈয়দ রাসেলকে পুল করতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন মাত্র ছয় রানেই। ফর্মের তুঙ্গে থেকে সেঞ্চুরি শূন্য থাকাটা তাঁর কতটা কষ্টের পরে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পেরেছিলাম। সে টেস্টে ভাসের সেঞ্চুরি সেই টেস্টে রান নেই সাঙ্গাকারার। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের টেস্টে পি সারা ওভারে মারলেন ডাবল হানড্রেড। মজার ব্যাপার, এই টেস্টে ৫০ থেকে ৬০টি বল পেয়েও সাঙ্গাকারা একটি বলেও পুল মারেননি বা চেষ্টা করেননি। বড় ক্রিকেটারই পারে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে সেঞ্চুরি করতে। শচীন একবার কোনো কাভার ড্রাইভ ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে প্রমাণ করেছিল কোনো ছকে বা কৌশল তাঁকে আটকানো যাবে না। যেমনি বাংলাদেশের বোলাররা পারেননি সাঙ্গাকারার পরপর দুটি ডাবল সেঞ্চুরি রুখতে।
পরে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল এক টেস্ট বাদে তাঁর সেঞ্চুরির গল্প। ভাসি (চামিন্দা ভাস) তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন কীভাবে ভুল শুধরে নিজেকে মেলে ধরতে হয়। প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি না পাওয়ায় পরের বেশকটি রাত তাঁকে থাকতে হয়েছিল নিদ্রাহীন। পি সারা ওভালের ওই টেস্টে সাঙ্গাকারা আমাদের সঙ্গে অনেক খোলামেলা কথা বলেছিলেন। কারণ আমরা অন্য একটি কারণে তাঁর কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। বিশেষ করে ১৮৮৯ সালে তামিলদের এই ক্লাবটি তৈরি। লঙ্কার ঐতিহাসিক ভেন্যুর একটি এটি। অথচ এই মাঠে প্রেস বক্সের অবস্থা বর্ণনা করার মতো নয়। মাঠের সোজা-সুজি সাংবাদিকদের বসার জায়গা। কিন্তু চারিপাশ খোলা। বসে কাজ করা সময় কাগজ উড়িয়ে নিয়ে যেত পাশের সুইমিংপুলে। ওই সফরে এই বিষয়টি আমাদের বেশ ভোগাচ্ছিল। একটা পর্যায়ে রেগে গিয়ে ম্যাচ রেফারি নিউজিল্যান্ডের জেফ ক্রোর কাছে অভিযোগ করলাম। তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই এই অভিযোগটা আমলে নিয়েছিল। আমার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদেরও সঙ্গে পেয়েছিলাম। পরে আইসিসির নির্দেশ অনুয়ায়ী পরের সপ্তাহের মধ্যই ওই ভেন্যুর প্রেস বক্স ঠিক হয়েছিল একেবারে এসিসহ। সম্ভবত এই কারণে ওই সফরে আমরা একটু বেশি আলোচিত ছিলাম লঙ্কান ক্রিকেটারদের কাছে। কারণ আমাদের হাত ধরে যে ভালো কিছু একটা হয়েছে এই ভেন্যুতে।
তাই পি সারা মানেই অনেক স্মৃতি। আর এই মাঠটিকে সাঙ্গাকারা বেছে নিলেন বিদায় জানাতে। কিন্তু তাঁর বিদায় টেস্টটা জয় হলো না। হলো না সাঙ্গাকারার সেঞ্চুরি। তাতে কি, গত ১৫টি বছর এই বাঁ-হাতির হাত ধরেই শ্রীলঙ্কা পেয়েছে অনেক প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে দুর্দান্ত জয়। যেমন ধরুন না ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের চার রানে পাঁচ উইকেট হারানোর পর; সাঙ্গাকারা ফিফটি বাংলাদেশকে শিরোপাবঞ্চিত করেছিল। এমন অনেক ম্যাচ আছে যেখানে সাঙ্গাকারা ঠান্ডা মাথায় তাঁর দলকে জিতিয়ে এনেছিলেন।
তবে তাঁর অনেক জয়ের মাঝেও তাঁর বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে না পারার একটা ছোট্ট আক্ষেপ হয়তো থেকে যাবে। তাতে কি মাঠে এবং মাঠের বাইরে ক্রিকেটের সত্যিকারের জেন্টলম্যান বলতে যা বোঝায় সাঙ্গাকারা তাই। তাই তাঁকে বিদায় জানাতে মন না চাইলেও বিদায় জানাতে হয়।
কিন্তু তিনি যা রেখে গেলেন তা থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটারের অনেক কিছু শেখার আছে। ভবিষ্যৎতে আশা করব লাল-সবুজের দেশ থেকেও যেন সত্যিকারের রিয়েল জেন্টলম্যান ক্রিকেটার তৈরি হয়। যাকে নিয়ে অহংকার করতে পারব আমরা।