বিশ্বকাপের অমর স্মৃতি
‘দ্য হ্যান্ড অব গড’
ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ শুরু হতে আর বাকি মাত্র ৯ দিন। বিশ্বকাপের হাওয়া এখন ভালোমতোই বইতে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে। স্মৃতিতে ভেসে উঠছে অমর সব স্মৃতি। প্রতি বিশ্বকাপের আগে যেসব স্মৃতি রোমন্থন না করে আসলে থাকতে পারেন না ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আয়োজিত এনটিভি অনলাইনের বিশেষ আয়োজনে এবার থাকছে বিশ্বকাপের তেমনই কিছু অমর স্মৃতির কথা। আজকের পর্বে থাকছে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত-কুখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের গল্প।
ঈশ্বর থাকেন সর্বত্র। তাই বলে ফুটবল মাঠে এসে দৈববলে নিজের হাতে গোল দিয়ে দেবেন? ব্যাপারটা কেউ হয়তো কল্পনায়ও আনবেন না। যদি না তাঁর নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা না হয়! চোখ-ধাঁধানো পারফরম্যান্স দিয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ মাতিয়ে রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত সে আসরের শিরোপাটাও উঠেছিল ম্যারাডোনারই হাতে। মাঠের দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পাশাপাশি অকল্পনীয় এক বিতর্কের জন্ম দিয়েও স্মরণীয় হয়ে আছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। এই বিশ্বকাপেরই কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি ইংল্যান্ডের জালে বল পাঠিয়েছিলেন হাত দিয়ে। পরে নিজেই সেই গোলের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ঈশ্বরই তাঁর হাত দিয়ে গোলটা করিয়ে নিয়েছেন! সেই থেকে গোলটির গায়ে পাকাপাকিভাবে বসে যায় ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’ উপাধিটি।
আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে খেলায় ফুটবলীয় উত্তেজনার বাইরেও অন্য রকম উত্তেজনা ছিল। আশির দশকে ইংল্যান্ডের কাছে ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের দগদগে স্মৃতিটা তখনো তাজা আর্জেন্টাইনদের মনে। তাই স্বাভাবিকভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পাশাপাশি গ্যালারি ও দুদেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় চলে আসে ম্যারাডোনার সেই গোল।
কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে দুপক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। উত্তেজনাকর ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ও অন্যতম সেরা ঘটনার জন্ম দেয়। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা খেলার ৫১তম মিনিটে একটি গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। কিন্তু পরে টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, গোলটি করার সময় ম্যারাডোনা হাত ব্যবহার করেন। হাত দিয়ে বলে আঘাত করে তিনি সেটিকে গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দেন। ম্যারাডোনা নিজেও পরে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি গোলটি ইচ্ছাকৃতভাবেই হাত দিয়ে করেছিলেন, তাঁর মাথা বল স্পর্শ করেনি। সে মুহূর্তে তিনি জানতেনও গোলটি অবৈধ।
ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন সঙ্গে সঙ্গেই অনেক প্রতিবাদ করেছিলেন। চার-পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলার গোল বাতিলের দাবি জানিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রেফারির দিকে। কিন্তু ব্যাপারটি রেফারি সত্যিই বুঝে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে ম্যারাডোনাও সতীর্থদের সঙ্গে এমনভাবে গোল উদযাপনে মেতে ওঠেন যে সেটি বাতিল করার চিন্তাও আসেনি কারো মাথায়।
এমন বিতর্কিত গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোল করেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। যে গোলকে পরে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে। মাঠের অর্ধেকের বেশি অংশ দৌড়িয়ে, পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে কাটিয়ে গোল করেন ম্যারাডোনা। ২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিতর্কিত হয়ে আছে ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাতের’ গোল।
২০০৫ সালের ২২ আগস্ট এক টেলিভিশন শোতে এসে ম্যারাডোনা পুরোনো বিতর্ক উসকে দেন। ওই প্রোগ্রামে তিনি স্বীকার করেন, বলে তাঁর মাথা ছোঁয়নি, বরং হাত লেগেছে। তবে তাঁর সুকৌশলী উত্তর ছিল এমন, 'ম্যারাডোনার খানিকটা মাথা আর ঈশ্বরের খানিকটা হাত, এ দিয়েই গোল!’
শুধু কোয়ার্টার ফাইনালের সাফল্য নয়। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তিনি জোড়া গোল করেন। ফাইনালে প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি তাঁকে ডাবল মার্কিং করে রাখে। তা সত্ত্বেও তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন হোর্হে বুরুচাগা। ইস্তাদিও আজতেকার এক লাখ ১৫ হাজার দর্শকের সামনে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩–২ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে শিরোপা বাগিয়ে নেয় আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের পুরো প্রতিযোগিতাজুড়ে ছিল ৫৮ বছর বয়সী ম্যারাডোনার দাপট। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের আতঙ্কের কারণ ছিলেন তিনি। কেবল নিজের একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার ঈশ্বরের হাত না থাকুক, তবে নিজের দেশকে এমন গৌরবময় সাফল্য এনে দেওয়ায় আর্জেন্টাইনদের কাছে তিনি হয়ে আছেন ‘ফুটবলের ঈশ্বর’।