পেলের বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপের পেলে
ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ শুরু হতে আর বাকি মাত্র আট দিন। বিশ্বকাপের হাওয়া এখন ভালোমতোই বইতে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে। স্মৃতিতে ভেসে উঠছে অমর সব স্মৃতি। প্রতি বিশ্বকাপের আগে যেসব স্মৃতি রোমন্থন না করে আসলে থাকতে পারেন না ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আয়োজিত এনটিভি অনলাইনের বিশেষ আয়োজনে এবার থাকছে বিশ্বকাপের তেমনই কিছু অমর স্মৃতির কথা। আজকের পর্বে থাকছে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের গল্প :
ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের বস্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর এক ছেলের জন্ম। দরিদ্র পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে অভাব-অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়। এর সঙ্গে রেলস্টেশনে ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কার করার কাজও করেছিলেন। তাঁর পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো’। নামটা রাখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সঙ্গে মিল রেখেই। কী, চেনা যায়?
এই মানুষটি বিশ্ববিখ্যাত ফুটবল তারকা কিংবদন্তি পেলে। ফুটবল সম্পর্কে জানেন না, এমন মানুষও পেলের নাম অন্তত শুনেছেন। ফুটবলে শুধু একজনের নাম নিতে হলে পেলের নামই আসবে।‘কালো মানিক’ খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। পেলে খেলেছেন এমন কোনো টুর্নামেন্টের সর্বকালের সেরা একাদশ থেকে মনে হয় তাঁকে বাদ দেওয়া যাবে না।
খুব ছোট বয়সেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত এই কিংবদন্তি মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের মতো দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য লাভ করেন। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে পেলের একমাত্র গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালে পৌঁছে। এই গোলের মাধ্যমে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৩৯ দিন) গোলদাতা হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লেখান ফুটবলের এই জাদুকর। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৪৪ দিন) হ্যাটট্রিকদাতার রেকর্ডও নিজের দখলে নেন। ফাইনালেও পান সাফল্য। দুই গোল করেন তিনি। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের সিলভার বল ও সিলভার বুট দুটোই জেতেন পেলে। এ ছাড়া সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কারও জেতেন তিনি।
১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ পেলের জন্য দুঃস্বপ্নের। আগের বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি নিয়ে খেলা শুরু করা পেলে চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে বাকি টুর্নামেন্টে আর খেলা চালিয়ে যেতে পারেননি।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল সেরা দল নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে পেলে গোল করেন, কিন্তু বুলগেরিয়ান ডিফেন্ডারদের অমানবিক ফাউলে ইনজুরিতে পড়েন। যার ফলে পরের ম্যাচ মিস করেন তিনি। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে হেরে যায় ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বের শেষ খেলায় ইউসেবিওর পর্তুগালের বিপক্ষে যখন কোচ পেলেকে নামান, সবাই অবাক হয়ে যায়। কারণ, তখনো পেলে ইনজুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওই ম্যাচকে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বাজে ম্যাচ বলে স্বীকার করা হয়। ওই ম্যাচে পুরো ব্রাজিল দলকে, বিশেষ করে পেলেকে এত বেশি পরিমাণ ফাউল করা হয় যে পেলে মাঠ থেকে অসুস্থ হয়ে বের হন। তিনি এতটাই ইনজুরড হয়ে মাঠ থেকে বের হন যে সেই ম্যাচের পর তিনি অবসরের ঘোষণাও দেন। পরে ইউসেবিও ও পর্তুগালের সমস্ত টিম মেম্বার অফিশিয়ালি ব্রাজিলের কাছে ক্ষমা চায়।
১৯৭০-এর বিশ্বকাপে অবশ্য পেলের খেলার কথাই ছিল না। কিন্তু ১৯৬৯ সালের শুরুতে পেলেকে আবার দলে নেওয়া হয়। তিনি যে ফুরিয়ে যাননি, তাঁর প্রমাণও রাখেন। বাছাইপর্বে ছয় ম্যাচে অংশ নিয়ে ছয়টি গোল করেন এই ব্রাজিলিয়ান। ফাইনাল ম্যাচে ইতালির বিরুদ্ধে প্রথম গোল পান তিনিই। পুরো টুর্নামেন্টে চারটি গোল আর সাতটি অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন তিনি। সঙ্গে বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে কাপটাকে চিরতরে নিজেদের করে নেন।
ফুটবলে প্রজন্ম একটা বড় বিষয়। এক প্রজন্ম সচরাচর দুটি বিশ্বকাপ ভালো খেলে। কিন্তু পেলে চারটি বিশ্বকাপেই তার পায়ের, কৌশলের জাদু দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, পরের প্রজন্মের সঙ্গে তিনি নিজেকে সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। পেলের বিশ্বকাপ খেলা যেদিন থেকে শেষ হলো, ফুটবলের রূপকথারও একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।