দুরন্ত মোহামেডানের দুর্দশা কেন?
একসময় খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখর থাকত মোহামেডান ক্লাব। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির বারান্দায় সাবেক খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা রাত-দিন আড্ডায় মশগুল থাকতেন। সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত মোহামেডানের একেবারে বেহাল দশা এখন। কর্মকর্তারা দুই ভাগে বিভক্ত।
ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা অজুহাতে তারা নির্বাচন দিচ্ছে না বলে দাবি করছেন কেউ-কেউ। এক সময়ের নিবেদিতপ্রাণ অনেক সংগঠককেও এখন ক্লাবে তেমন দেখা যায় না।
অনেকের অভিযোগ, এই দ্বন্দ্বের কারণে ফুটবল ও ক্রিকেটে তেমন ভালো দল গড়তে পারছে না মোহামেডান। আর হকি তো মোহামেডান খেলছেই না ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে।
অনেক দিন ধরে ফুটবল-ক্রিকেট দুটোতেই ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাবটি। ২০০২ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাই ফুটবলে মোহামেডানের সর্বশেষ বড় সাফল্য। ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ শুরু হওয়ার পর এই প্রতিযোগিতায় একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তারা। স্বাধীনতার পর ঢাকা লিগের ১২ বারের চ্যাম্পিয়নরা পেশাদার লিগের সাত আসর কেটে যাওয়ার পরও শিরোপাশূন্য! বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়।
মাঝেমধ্যে সুপার কাপ বা ফেডারেশন কাপ জিতলেও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নামে পরিচিত পেশাদার লিগে মোহামেডানের ব্যর্থতা সত্যিই অবিশ্বাস্য। মোহামেডান-ভক্তদের কাছে এর চেয়ে হতাশাজনক আর কী হতে পারে! এ কারণে অনেকবার সমর্থকদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে বর্তমান কমিটির কোনো-কোনো কর্মকর্তাকে।
ক্রিকেটেও একই রকম শোচনীয় অবস্থা। ঢাকা লিগে মোহামেডান সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০৯-১০ মৌসুমে। তার পর থেকে শিরোপা ‘সোনার হরিণ’ হয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির জন্য। কারণ ওই একই, ভালো দল গড়তে না পারা। গতবার তো লিগে পঞ্চম স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
বর্তমান কমিটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ, তাঁদের মধ্যে ভালো দল গড়ার আগ্রহই নেই। অথচ একাই দল গঠন করার ক্ষমতা রাখেন, এমন কয়েকজন ক্রিকেট কর্মকর্তা ক্লাবটি ছেড়ে চলে গেছেন।
হকি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোহামেডানের এক কর্মকর্তাকে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বানানোর জন্য তাঁরা ফেডারেশনের সব ধরনের কার্যক্রম বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। গত মৌসুমে হকি লিগে অংশই নেয়নি মোহামেডান। আসছে মৌসুমেও না খেলার ঘোষণা দিয়েছে। ফেডারেশন লিগে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিলেও এ ব্যাপারে ন্যূনতম আগ্রহ দেখায়নি ক্লাবটি।
হকি বয়কটের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সাজেদ এ এ আদেল। মোহামেডানের হকি কমিটির সাবেক সম্পাদকের মতে, ‘খেলাধুলার জন্যই তো মোহামেডান। ফেডারেশনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে, কিন্তু সে জন্য খেলাধুলা বন্ধ করা যাবে না। খেলার বাইরে থাকার এই সিদ্ধান্তকে একজন সাবেক খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা হিসেবে আমি সমর্থন করি না। ক্লাবের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়।’
মোহামেডানের পরিচালক ও হকি কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন অবশ্য বয়কট চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর যুক্তি, ‘হকি ফেডারেশনের বর্তমান কমিটি বৈধ নয়। এই কমিটির অধীনে মোহামেডানসহ চারটি ক্লাব কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না। ফেডারেশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া ঠিক ছিল না বলেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকব।’
ক্লাবের চলমান ব্যর্থতার জন্য ক্ষমতা ‘আঁকড়ে’ থাকা কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন সাবেক তারকা ফুটলার বাদল রায়। মোহামেডানে দীর্ঘ দিন খেলেছেন। এক মৌসুম পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। প্রিয় ক্লাবের দুর্দশায় হতাশ বাদল ব্যর্থতার জন্য কর্মকর্তাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করে বলেছেন, ‘মোহামেডান একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাবের দুর্দশা আমাকে বড্ড পীড়া দেয়। মোহামেডান যে কীভাবে চলছে তা ভাবলেই অবাক হয়ে যাই।’
‘এ জন্য পুরোপুরি দায়ী বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। দীর্ঘ দিন এই ক্লাবের হয়ে খেলেছি। কর্মকর্তা হিসেবেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। কখনোই এমন দুরবস্থা দেখিনি। বিভিন্ন সময় অর্থ সংকটও দেখেছি, কিন্তু এর মধ্যেও মোহামেডান ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কর্মকর্তাদের কারণেই এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
বাদল রায়ের এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। কারণ প্রায় দেড় বছর আগে মোহামেডানের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনো নির্বাচন হয়নি। গত বছরের ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও তখনকার অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত করা হয়। আজও নতুন তারিখ জানানো হয়নি।
মোহামেডানের সাবেক অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক ও পরিচালক মোস্তাকুর রহমান সংকট থেকে উত্তরণে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পক্ষপাতী, ‘বর্তমান কমিটিতে এমন কোনো কর্মকর্তা নেই যিনি ক্লাবকে আগের মতো ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন। কর্মকর্তারা বরং ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে ক্লাবের ক্ষতিই করছেন। অদক্ষতার কারণে তাঁরা ঠিকমতো ক্লাব পরিচালনা করতে পারছেন না।’
‘দ্রুত নির্বাচন দেওয়াই এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে বড় উপায়। এর মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া।’
এই নির্বাচন আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে। দীর্ঘ দিন শুনানির পর গত ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য রায় দিয়েছেন। বর্তমান ২১৩ জন স্থায়ী সদস্যকে নিয়েই নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালতের নির্দেশ মেনে শিগগিরই নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি ক্লাবটির ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেনের কণ্ঠে, ‘গত বছরের জানুয়ারিতে রাজনৈতিক সংকটের কারণে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। তাই নির্বাচন পেছানোর সময় চেয়ে আমরা আদালতে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত যে রায় দিয়েছেন, আমরা সে অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
‘খুব দ্রুত পরিচালনা পর্ষদের সভায় বসে আমরা নির্বাচনের তারিখ ঠিক করব। নির্বাচনের আগে কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে। এসব নিয়েই আমরা এখন কাজ করছি।’