কেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ মানে অর্থহীন কিছু ম্যাচ
‘২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের কথা ভাবুন। সেটা ছিল একটা বাণিজ্যিক বিপর্যয়। কারণ, ভারত গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়েছিল। ফলস্বরূপ, দেশটির বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমী তাঁদের টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ভারতীয় সম্প্রচারকারীরা হারিয়েছিল কোটি কোটি ডলারের বিজ্ঞাপনী মুনাফা। আর যাঁরা এই জনপ্রিয় খেলাটা পরিচালনা করেন, সেই ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা পড়েছিলেন বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে।’
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক একদিন পর (১৫ ফেব্রুয়ারি) ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল এ কথাগুলো। বিশ্লেষণধর্মী এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘কেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনেকগুলো অর্থহীন ম্যাচের সমাহার’। ক্রিকেট-বাণিজ্যের জন্য ভারতের যে বিশ্বকাপে টিকে থাকা খুবই প্রয়োজন, তা বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছিল প্রতিবেদনটিতে।
আর বিশ্বকাপের মাঝপর্যায়ে এসে এই প্রতিবেদনের যথার্থতা যেন আরো ভালোভাবে ফুটে উঠল ভারত-বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালের মধ্য দিয়ে। চরম বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের বলি হয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হলো বাংলাদেশকে। মাশরাফির বলে এলবিডব্লিউর রিভিউ, বিতর্কিত নো বল ডেকে রুবেলকে রোহিত শর্মার উইকেট বঞ্চিত করা, বাংলাদেশের পক্ষে টানা দুই ম্যাচে শতক করা মাহমুদউল্লাহর বিতর্কিত ক্যাচ—পুরো ম্যাচেই বারবার হতাশ আর ক্ষুব্ধ হতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে ইকোনমিস্টের মতো পত্রিকায় ভারতকে টিকিয়ে রাখা নিয়ে যে ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বিপক্ষে যাওয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো মেলালে সত্যিই অবাক হতে হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘২০০৭ সালের মতো বিপর্যয় যেন আর না হয়, সে জন্য এবারের বিশ্বকাপ এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন বড় দলগুলো, বিশেষত ভারত শিরোপা জয়ের দৌড়ে টিকে থাকে। যেন কোটি কোটি ভারতীয় সমর্থক তাদের টেলিভিশন চালু রাখেন, যতটা বেশি সময় ধরে সম্ভব। তা না হলে ভারতের সমর্থকরা হয়তো সেটাকে অমর্যাদাকর বলে বিবেচনা করতে পারে। তাদের নায়করা তো আবার ক্রিকেটবিশ্বের বর্তমান শিরোপাজয়ী।’
যেভাবে গ্রুপ ভাগ করা হয়েছিল, তাতে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ আটটি দলেরই যাওয়ার কথা নকআউট পর্বে। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। ‘অঘটন’ ঘটিয়েছে শুধু বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে র্যাঙ্কিংয়ের নবম দল। সেমিফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে আবারও ভারতকেন্দ্রিক ক্রিকেট-বেনিয়াদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। হারের স্বাদ দিতে বসেছিল ভারতকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারদের ‘কৃপায়’ বাংলাদেশকে হারিয়ে পরিকল্পনামাফিকই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে ‘টিম ইন্ডিয়া’।
ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণের ব্যাপারটি ঘটছে অনেক দিন ধরেই। তবে বর্তমান সময়ে সব সৌন্দর্য, দক্ষতা-প্রতিভা দূরে ঠেলে ক্রিকেটকে শুধুই ব্যবসা-বাণিজ্য আর মুনাফা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, এ সম্পর্কিত প্রশ্ন বেশ জোরেশোরেই উঠেছে ক্রীড়াঙ্গনে। বিশ্বকাপে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের প্রতি সত্যিই অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে কি না, বাংলাদেশের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে কি না, তা তলিয়ে দেখার দাবি রাখে।