বিশেষ অলিম্পিক : অবহেলিতরাই বয়ে আনল মর্যাদার পদক
কেউ কথা বলতে পারে না, কানেও শুনতে পায় না, আবার কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধিও। অন্য আর সব স্বাভাবিক মানুষের মতো জ্ঞান বুদ্ধিও ওদের নেই। জন্মগতভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা এদেরকে সমাজে নাম দিয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। তবে প্রচণ্ড স্নায়বিক শক্তি এদের। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব শিশুরা পরিবার থেকেও পায়নি আদর ভালবাসা, অনাদরে বেড়ে ওঠা পাবনার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুরাই খেলাধুলায় বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়ে এনে দিয়েছে সামার স্পেশাল অলিম্পিক গেমসে অসাধারণ সাফল্য। পাবনা থেকে ১২ জন অ্যাথলেট অংশ নিয়ে ১২টি সোনা ও চারটি ব্রোঞ্জ পদক জিতে দেশের সম্মান বয়ে এনেছে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুদরে এমন সাফল্যে বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিকের পরিচালক ও পাবনা সাব চ্যাপটারের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হোসেন বাদশা বার্লিন থেকে এনটিভিকে জানান, গত ১৭ জুন মেস বার্লিন, হানস ব্রাউন স্টেডিয়াম, মাইফেল্ডসহ আরও দুটি অলিম্পক পার্কে বিশ্বের ১৯০টি দেশের ৭ হাজার বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৭৯ জন খেলোয়াড় ও কোচ অন্যান্য মিলে ১১৩ জন অংশ নেয়। তার মধ্যে শুধু পাবনা সাব চ্যাপটার থেকেই ১২ জন অংশ নিয়ে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে ব্যাডমিন্টনে চারটি সোনা, সাঁতারে চারটি সোনা এবং হ্যান্ডবলে চারটি সোনা ও চারটি ব্রোঞ্জ লাভ করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ২৬টি সোনা ও ছয়টি করে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে।
রেজাউল হোসেন বাদশা আরও জানান, আন্তর্জাতিকভাবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ সম্মান। ২৫ জুন এই অলিম্পিক শেষ হয়।
পাবনা সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কিশোরী সাদিয়া খান সেতু জন্ম থেকেই কথা বলতে পারে না এবং কানে শুনতে পারে না। পরিবারের সবার কাছেই ছিল অবহেলার পাত্রী। সেতুর মা আলেয়া বেগম এনটিভিকে বলেন, সেতুর পর তার দ্বিতীয় ছেলে সন্তানও যখন একই প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তখন তার পরিবারের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেওয়া দুই শিশু সন্তানকে ফেলে তাদের পিতা আবারও একটি বিয়ে করে। পরিবারের সবার অনাদরে, অনাগ্রহে বড় হতে থাকে তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দুই সন্তান; তবে কখনও তিনি হতাশ হননি।
কথা বলতে ও কানে শুনতে না পারলেও তার দুই ছেলে-মেয়েই খেলাধুলায় ছোটবেলা থেকেই ছিল পারদর্শী। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি স্কুলে ভর্তি করার পর মেয়ে সেতু স্পেশাল অলিম্পিক সাব-চ্যাপ্টার পাবনার কর্মকর্তাদের নজরে আসে। প্রশিক্ষণ শেষে বার্লিনের স্পেশাল অলিম্পিকে হ্যান্ডবলে দুটি স্বর্ণপদক লাভ করে। স্পেশাল অলিম্পিক, পাবনা সাব-চ্যাপ্টার এর কর্মকর্তারা এনটিভিকে জানান, ২০১০ সালে সংগঠনটির যাত্রা শুরু করার পর থেকে ইতোমধ্যে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিক জয়ের পর অস্ট্রেলিয়ার এশিয়া স্পেসিফিক গেমস, আমেরিকায় অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিক ওয়ার্ল্ড গেমস, অস্ট্রিয়ায় ইউনটার ওয়ার্ল্ড গেমস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ওয়ার্ল্ড সামার গেমস এ অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। এসব আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট থেকে পাবনার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন খেলোয়াররা এর আগে ২৩টি পদক জিতেছে এর মধ্যে ১৪টি স্বর্ণ পদক রয়েছে। এবারের স্পেশাল অলিম্পিক গেমসে তাদের সাফল্য বাড়িয়ে দিয়েছে আরও নতুন নতুন স্বপ্ন জয়ের হাতছানি। দেশের বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এনটিভিকে বলেন, এই সফলতা দেশের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিকের প্রশিক্ষক মুর্তজা ইকবাল নুরি এনটিভিকে বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুদের ইশারার মাধ্যমে শেখাতে হয়। অনেক সময় তারা সঠিকভাবে মনে রাখতে পারে না, সে জন্য অনেক ধৈর্য্য ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুরা সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবে। যার প্রমাণ তারা আগেও দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিক পাবনা সাব চ্যাপটারের সভাপতি ও পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন এনটিভিকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই পাবনার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে অনেক ভালো ফলাফল করছে। তারই ধারাবাহিকতা এই সাফল্য। এদিকে অন্ধকারে ভরা ছিল যাদের জীবন তাদের এমন সাফল্য এখন দ্যুতি ছড়াচ্ছে তাদের পরিবারে, সমাজে ও সারা দেশে। একসময় যারা তাদের অবহেলা করত তারাও এখন এসব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে গর্বিত।