সাক্ষাৎকার
চাপমুক্ত ক্রিকেটই হৃদয়ের সাফল্যের রহস্য
রঙিন পোশাকে দেশের হয়ে খেলেছেন মাত্র ১৭টি ম্যাচ। সময়ের হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা ৬ মাসের। এই অল্প সময়েই ভক্তদের হৃদয়ে জায়গা পাকা করে নিয়েছেন তাওহিদ হৃদয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রথমবার ফ্রাঞ্চাইজি লিগ খেলতে গিয়ে জয় করেছেন লঙ্কান ভ্ক্তদের হৃদয়ও। তার আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ও বিপিএলে স্বপ্নময় পথচলা।
সবকিছু ছাপিয়ে হৃদয়ের সামনে সুযোগ জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ মাতানো। তার আগে পাড়ি দিতে হবে এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজ। কিন্তু, হৃদয় নিজেকে আটকে রাখছেন বর্তমানের ফ্রেমেই। আগেভাগে বড় স্বপ্ন না দেখে এগোতে চান ধাপে ধাপে। সে জন্য সবসময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন ২২ বছর বয়সী এই তরুণ ক্রিকেটার।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফ্রাঞ্চাইজি লিগে খেলার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন তাওহিদ। সেই সঙ্গে জানালেন, এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথাও।
এশিয়া কাপ দিয়ে প্রথমবার বড় কোনো টুর্নামেন্টে সুযোগ পেলেন, কেমন লাগছে?
উত্তর : ধন্যবাদ আপনাকে। এটা অবশ্যই অনেক বড় সুযোগ। শুধু আমার জন্য নয়, বড় টুর্নামেন্টে সুযোগ পাওয়া প্রতিটি ক্রিকেটারের জন্য অনেক বড় কিছু। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই সুযোগটা কাজে লাগানো মূল কথা। টিম ম্যানেজমেন্ট যেভাবে আস্থা রেখেছেন তার প্রতিদান দেওয়াটা মূল লক্ষ্য। চেষ্টা থাকবে বড় জায়গায় নিজেকে প্রমাণ করা।
ব্যাট হাতে সময়টা ভালো যাচ্ছে সেই সঙ্গে বড় টুর্নামেন্টে সুযোগ পাওয়া, পরিবারের উচ্ছ্বাস কতটা?
উত্তর : আমার বাড়িতে আসলে সময়সময়ই একই থাকে। কেউ অতি উৎসাহী নয়। যখনই যেখানে সুযোগ পাই নরমালই থাকে। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। খুশি সবাই এইতো। আমি নিজেও যে কোনো জিনিস নিয়ে এত উচ্ছ্বাসিত হই না। এসব খুব পছন্দ করি না। খুব সাধারণভাবে দেখি। পরিবারের সবাইও তেমন। জাতীয় দলে খেলার আগেও এমনই ছিল। ভালো খেললেও তেমন উচ্ছ্বাস নেই, আবার খারাপ খেললেও কোনো কথা নেই। অলয়েজ নরমাল।
এই ব্যাপারটা কি আপনার ওপর চাপ আরও কমিয়ে দেয়?
উত্তর : আসলে চাপ কি জিনিস আমি সেটা নিয়ে ভাবি না। বাইরে কি হলো বা না হলো সেসব কখনোও ভাবায় না। নিজের কাজে ফোকাসড থাকার চেষ্টা করি। আমার পারিবারিক দিক থেকে অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ না থাকায় নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করি। আমি যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনই হচ্ছে।
খুব দ্রুত সময়ে সবার মন জয় করেছেন, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : আসলে ‘গড গিফটেড’ কিছু জিনিস থাকে। হয়তো আল্লাহ আমাকে সেটা দিয়েছেন। এত অল্প সময়ে সবার মাঝে জায়গা করে নিতে পারব এটা নিজেও বুঝতে পারিনি। হয়তো ভালো খেলেছি বলে জায়গাটা হয়েছে। জানি না কতদিন মানুষের মনে জায়গা ধরে রাখতে পারব। মানুষজন পরে কতটুকু রিয়াক্ট করবে সেটাও জানি না। তবে আমি দেখতে চাই কখনও খারাপ সময় আসলে মানুষজন কেমন থাকে! শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, আমার দলের সবার ক্ষেত্রে এটা দেখতে চাই। ভালো সময় সবাই সমর্থন করে। খারাপ সময় এটা পাল্টে যায়। আমি দেখতে চাই আমার খারাপ সময় মানুষ আমাকে সমর্থন দেয় কিনা!
যখনই মাঠে নামেন খুব নির্ভার থাকেন, কীভাবে মানিয়ে নেন?
উত্তর: একজন ব্যাটসম্যানকে নিজেকে শান্ত রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, খেলাটা এক বলেরই। একটা বলে যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। ভাবনা চিন্তা ওই একটা বল নিয়েই। আমিও বল বাই বল চিন্তা করি। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার থাকে যে—কীভাবে সামলাবো, কোন শর্টটা খেলবে কিংবা কী হবে! তো এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কিংবা প্রতিপক্ষের বোলারকে বুঝে মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে শান্ত রাখাটা জরুরি। আমি সেটা ট্রাই করি। নিজেকে যতটা শান্ত রাখা যায় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ততটাই সহজ হয়। আমি সেটা করেই নিজেকে নির্ভার রাখার চেষ্টা করি।
ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ নিয়ে কাউকে অনুসরণ করেন কি না?
উত্তর : না ওইভাবে কাউকে ফলো করি না। আমার এই অ্যাপ্রোচগুলো আমার সম্পূর্ণ নিজের। নিজের মতো কাজ করি। নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি। তবে সবার খেলা দেখি। কিন্তু নির্দিষ্ট করে নিজের জন্য কিছু ফলো করি না।
প্রথমবার ফ্যাঞ্চাইজি লিগ খেলে ফিরলেন, অভিজ্ঞতা কেমন হলো?
উত্তর : খুব অল্প সময় আমি ফ্রাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছি। যেটা আমার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। একটা নতুন পরিবেশ, নতুন দল—সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ওতটা সহজ ছিল না। সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ভালো করাটা লক্ষ্য ছিল। প্রতিটি দিনই আমার সেখানে নতুন ছিল। চেষ্টা করিছি নিজেকে মানিয়ে নিতে। কতটা পেরেছি জানি না। তবে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। হয়তো সামনে সুযোগ পেলে আরও ভালো হবে।
নিজেদের উন্নতির জন্য বাইরের লিগগুলোতে খেলাটা কতটা জরুরি মনে করেন? প্রথমবার গিয়ে আপনি নিজে কতটা শিখতে পেরেছেন?
উত্তর : অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গেলে আমার কাছে মনে হয়েছে ফ্যাঞ্চাইজি লিগটা অনেক কঠিন। যখন আপনি বিদেশি ক্রিকেটার হবেন তখন আপনার কাছে প্রত্যাশার মাত্রাটা অনেক বেশি থাকে। বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে জায়গাটা নির্দিষ্ট থাকে। আপনাকে যেদিন সুযোগ দিবে সেদিন আপনার প্রতি প্রত্যাশাও বেশি থাকবে। টিম চাইবে—আপনি যেন ভালো একটা ইনিংসে খেলেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই। আসলে তখন মন থেকেই আলাদাভাবে ভালো পারফর্ম করার তাগিদ থাকে। চেষ্টা করি নিজের সেরাটা দেওয়ার। জানিনা কতটুকু হয়েছে। তবে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। এবার হয়তো হয়নি সামনে সুযোগ পেলে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। আমার কাছে মেইন যে জিনিসটা মনে হয়েছে, এখানে চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জ ফেস করাটা অনেক কিছু। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। অনেক কিছু নেওয়ার আছে। এটা প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্যই হেল্পফুল। নতুন জায়গায় গেলে অনেক কিছু শেখা যায়। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া যায়। এটা অবশ্যই সাহায্য করে।
গল টাইটান্সের বিপক্ষে সাকিবকে ছক্কা-চার হাঁকিয়েছেন। জাতীয় দলের সতীর্থকে মোকাবিলা করার মিশ্র অভিজ্ঞতাটা কেমন?
উত্তর : এই স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। ম্যাচ শেষে এটা নিয়ে তেমন আলাপও হয়নি। ব্যাটিং শেষে সাকিব ভাইয়া শুধু বলেছেন—গুড ব্যাটিং।
সামনেই এশিয়া কাপ ম্যাচ খেলবেন শ্রীলঙ্কায়। তার আগে ফ্রাঞ্ঝাইজি লিগ খেলায় কতটা কাজে আসবে?
উত্তর : এটা তো অবশ্যই দলের কাজে দেবে। যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। আমি সাকিব ভাই, শরিফুল বা যারাই ওখানে গিয়েছে তারা কন্ডিশন নিয়ে ভালো ধারণা পেয়েছেন। বাকিদেরও শ্রীলঙ্কায় খেলার অভিজ্ঞতা আছে। তো মনে হয়, ওই কন্ডিশনে ভালো কিছুই হবে। আমরা যদি প্রতিটি ম্যাচ বাই ম্যাচ ভালো করতে পারি তাহলে আশাকরি ভালো একটা টুর্নামেন্ট হবে।
এশিয়া কাপে কোনো লক্ষ্য স্থির করেছেন?
উত্তর : আমার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য কখনও থাকে না। আমি সবসময়ই বর্তমান নিয়ে থাকার চেষ্টা করি। বর্তমানে যা হলো সেটাতে ফোকাসড থাকা। পরে কী হবে, সামনে এটা করব ওটা করব এসব নিয়ে আমি কখনই ভাবি না। প্রতিটা দিনই আমি নতুন করে শুরু করতে চাই। ওই দিনে কতটা কি করা যায় সেটাই মূল ভাবনা।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
উত্তর : শতভাগ আশা আছে জিততে পারবে। আমরা যদি নিজেদের পরিকল্পনাগুলো মাঠে ফলাতে পারি অবশ্যই আমাদের সম্ভাবনা আছে। যদি আমরা ভালো করি রেজাল্ট ভালো হবে। আমাদের সবাইকে দল হিসেবে খেলতে হবে। সবাইকে সবার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। দল হিসেবে খেললে যে কোনো কিছুই সম্ভব। আমরাও যদি তা করতে পারি তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে।
এশিয়া কাপের পর বিশ্বকাপে খেলার হাতছানি আপনার সামনে। বিশ্বকাপ নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
উত্তর : বিশ্বকাপ তো অনেক পরের গল্প। ততদিন সুস্থ থাকব কিনা কিংবা দলে থাকতে পারব কিনা সেটাও নির্দিষ্ট করে জানি না। তাই আমি বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছি না। সময় সব বলে দেবে। এখন যেহেতু এশিয়া কাপ সামনে সেটাতেই ফোকাসড। যখন যে সময় আসবে তখন সেটা নিয়ে থাকার চেষ্টা করি।
দল থেকে কতটুকু সাপোর্ট থাকে?
উত্তর : অধিনায়ক ও কোচ অতিরিক্ত কোনো চাপ দেন না। তবে প্রতিটি দলের আলাদা একটা পরিকল্পনা থাকে। এটা সবার জন্যই। টিমের যতটুকু যা দরকার সেটা সবাইকেই করতে হয়। দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করি। এক্সট্রা কোনো চাপ নেই।
বাড়িতে কেমন পরিবেশ। আপনি এখন বাকিদের তারকা বন্ধু। সবমিলিয়ে কেমন যাচ্ছে?
উত্তর : এটাও নরমাল। ছোট থেকে যাদের সঙ্গে মিশতাম তাদের সঙ্গেই মিশি। যতটা পারি বাড়িতেও নরমাল থাকার চেষ্টা করি। হয়তো মানুষজন এখন দেখলে কাছে আসে, কথা বলে কিংবা ছবি তোলার চেষ্টা করেন ওইটুকুই। এসব উপভোগ করি। মানুষজনের ভালোলাগার জায়গাতে আছি। এটা তো অবশ্যই উপভোগ করি। চেষ্টা করব সবার আস্থা রাখতে।
দর্শকদের জন্য কিছু বলবেন?
উত্তর : দর্শকদের জন্য একটা কথাই বলতে চাই এত অল্প সময়ে তারা আমাকে এতটা সাপোর্ট করেছেন এটা যেন থাকে। আমি সবসময় দর্শকদের হদয়ে থাকতে চাই। সবার ভালোবাসার দাম দিতে চাই। যারা ক্রিকেট ভালোবাসেন তারা দলের পাশে সবসময় থাকবেন। শুধু আমাকে না আমাদের দলের সবার পাশে থাকুন। সবাইকে সাপোর্ট করুন। দল ভালো করুক কিংবা খারাপ করুক সবসময় একই রকম সাপোর্ট করুন। খারাপ সময়ে আপনাদের সাপোর্টটা আরও বেশি করবেন। আমরাও চেষ্টা করব আপনাদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে।
এনটিভি অনলাইন: ধন্যবাদ আপনাকে
তাওহিদ হৃদয়: আপনাকেও ধন্যবাদ।