কেমন ছিল বাংলাদেশের ছয় বিশ্বকাপ?
সপ্তমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নিতে চলেছে বাংলাদেশ। আগের ছয়বারের চেয়ে এবারের আসরে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রত্যাশা বেশি। গত কয়েক বছরে একদিনের ক্রিকেটে সমীহ জাগানিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয়ে গড়া চন্ডিকা হাথুরুসিংহের এই বাংলাদেশ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিণত। তাই, ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশাও বেশি।
এর আগে ছয়টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত হওয়া সবগুলো আসরেই ছিল লাল-সবুজের পতাকা। কেমন ছিল বাংলাদেশের ছয় বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা?
১৯৯৯
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের পর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। সে আসরে মোট পাঁচটি খেলায় নবাগত দলটি তুলে নেয় দুটি জয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ২৪ মে ১৯৯৯ স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে স্বাগতিকদের ২২ রানে হারায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের করা ১৮৫ রানের জবাবে ১৬৩ রানে থামে স্কটিশরা। বাংলাদেশ নিজেদের দ্বিতীয় জয় পায় পাকিস্তানের বিপক্ষে। ৩১ মে ১৯৯৯ ইংল্যান্ডের নর্থহ্যাম্পটনে ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হয় বাংলার মানুষ। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৯ উইকেটে ২২৩ রান করে বাংলাদেশ। জবাবে খালেদ মাহমুদ সুজনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে পাকিস্তানকে ১৬১ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। ৬২ রানের জয় তুলে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে জানান দেয় নিজেদের সরব উপস্থিতি। দুই ম্যাচ জিতলেও হার মানে অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডের কাছে।
২০০৩
আগের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর সুখস্মৃতি সঙ্গী হলেও বাংলাদেশের ২০০৩ বিশ্বকাপ কেটেছে ভুলে যাওয়ার মতো। এই একটি আসরেই কেবল জয়বঞ্চিত ছিল বাংলাদেশ। হেরেছে ছয় ম্যাচের সবকটিতে। কানাডার বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু। এরপর শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের কাছে হার। শেষ ম্যাচে এমনকি জিততে পারেনি কেনিয়ার বিপক্ষেও। কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে হেরে শেষ হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ।
২০০৭
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেবারই প্রথম গ্রুপ পর্বের বাধা পার হয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০০৭ এর আসর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিশেষ বলা চলে। সে আসরেই একসঙ্গে বিশ্বকাপ অভিষেক ঘটেছিল এমন তিনজনের, যারা পরবর্তীতে পালটে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট চিত্র। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের আগমনী বার্তা ক্রিকেট দুনিয়া পায় ২০০৭ বিশ্বকাপে। আসরের প্রথম ম্যাচে ১৭ মার্চ ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। ভারতীয় পেসার জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ১৭ বছর বয়সী তামিম ইকবালের মারা ছয়ে জয়ের আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ দলে। ভারতের ১৯১ রানের জবাবে পাঁচ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলে বাংলাদেশ। তামিম ৫১ ও সাকিব করেন ৫৩ রান। মুশফিক ৫৬ রানে অপরাজিত থেকে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বারমুডার বিপক্ষে সহজ জয়ে সুপার এইটে ওঠে বাংলাদেশ। যদিও, সুপার এইটে ছয় ম্যাচের মধ্যে কেবল একটিতে জয়ের দেখা পায় তারা। তবে, সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৩ বলে ৮৭ রানের চমৎকার ইনিংসে বাংলাদেশ করে ২৫১ রান। জবাবে ১৮৪ রানে অলআউট হয় প্রোটিয়ারা। বাংলাদেশ পায় ৬৭ রানের জয়। ২০০৭ বিশ্বকাপে মোট ৯ ম্যাচ খেলে তিনটিতে জয় পায় বাংলাদেশ।
২০১১
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হয় বাংলাদেশ। ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে ছয় ম্যাচ খেলে তিনটিতে জয় পায় সহ-স্বাগতিকরা। প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হারার পর দ্বিতীয ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন সাকিব আল হাসানরা। কিন্তু, মাত্র ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জায় পড়ে বাংলাদেশ। তৃতীয় ম্যাচেই অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় তুলে নেয়। ইংল্যান্ডের ২২৫ রানের জবাবে দুই উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ পায় অবিস্মরণীয় এক জয়। ১৬৯ রানে আট উইকেট হারানোর পর হারটা যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল, তখন মাহমুদউল্লাহ ও শফিউল ইসলামের অবিচ্ছিন্ন ৫৮ রানের জুটিতে বাংলাদেশ জয় তুলে নেয়।
আসরে আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সহজ জয় পায় বাংলাদেশ। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অলআউট হয় মাত্র ৭৮ রানে। ছয় ম্যাচে তিন জয় ও তিন হারে নেট রান রেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় বাংলাদেশকে।
২০১৫
সমৃদ্ধ এক স্কোয়াড নিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু সেবারও তিন জয়ের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেননি মাশরাফী-তামিমরা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানের জয়ের পর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় উইকেটের জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। স্কটিশদের করা ৩১৮ রান তামিমের ৯৫ রানে ভর দিয়ে মাত্র চার উইকেট হারিয়েই টপকে যায় তারা। ২০১১ বিশ্বকাপের পর শক্তিশালী ইংল্যান্ডের আরেকবার জয় পায় বাংলাদেশ। এবার তাদের হারায় ১৫ রানে। বাংলাদেশের ২৭৫ রানের জবাবে ইংরেজরা থামে ২৬০ রানে। আগে ব্যাট করা বাংলাদেশের হয়ে ১০৩ রান করেন মাহমুদউল্লাহ। যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি। পরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ১২৮ রানের আরেকটি অনবদ্য ইনিংস উপহার দেন মাহমুদউল্লাহ। যদিও, তিন উইকেটে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।
সে আসরে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিলেও ভারতের কাছে বিতর্কিতভাবে ম্যাচ হেরে বিদায় নিতে হয় বাংলাদেশকে। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সাত ম্যাচ খেলে তিনটি করে জয় ও হারের দেখা পায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়।
২০১৯
১০ দলের অংশগ্রহণে হওয়া ২০১৯ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বে ৯ ম্যাচ খেলে। ৯ ম্যাচের তিনটিতে জয় পায় মাশরাফীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রান, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ২১ রান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সাত উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। সর্বশেষ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান দুই শতক ও পাঁচ অর্ধশতকে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬০৬ রান করেন সাকিব।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ছয়টি বিশ্বকাপে মোট ৪২টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। তাতে ১৪ ম্যাচে জয়ের হাসি হাসে তারা। ২৫টিতে হার ও তিনটি ম্যাচ হয় পরিত্যক্ত। ২০২৩ বিশ্বকাপে কেমন করে বাংলাদেশ, অপেক্ষা এবার সেটি দেখার।