মাহমুদউল্লাহ : দুঃখী রাজপুত্র কিংবা অকূল দরিয়ার মাঝি
হারিয়ে যাবার আগে হারতে নেই। জীবন একটা ক্যানভাস। রঙ ছড়ানোর আগে থেমে যেতে নেই। ঝিনুক নিরবে সয়ে যায়। একদিন মুক্তো হয়ে উন্মোচিত হয়। মাহমুদউল্লাহকে বলা হয় বাংলার ক্রিকেটের নিরব ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলার। এত সুন্দর উপাধি আসলে তার সঙ্গেই মানায়। যতবার তার প্রয়োজন হয়েছে বাংলার ক্রিকেটে, ততবার তিনি ফিরে এসেছেন। এক বুক দুঃখ জমিয়েছেন, তবু টুঁ শব্দ নেই।
মাঠের ক্রিকেটে বুক চিতিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বমঞ্চে সেটি আরও বেশি করে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেঞ্চুরি ছয়টি। সাকিব আল হাসানের দুই, মুশফিকুর রহিমের এক। বাকি তিনটি মাহমুদউল্লাহর। বাংলাদেশও পারে বিশ্বকাপে শতক হাঁকাতে, সেই সাহস প্রথম মাহমুদউল্লাহই করেছিলেন।
চলতি বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশ দলে বিতর্ক, তামিম কেন নেই? জল কম ঘোলা হয়নি। আরেকটু আগে ফিরে যাই। দলে নেই মাহমুদউল্লাহ। কথিত বিশ্রামে তাকে দল থেকে চিরতরে বাদ দিতে কত চেষ্টা। তার বিকল্প খুঁজতে কতজনকে খেলানো হলো। আফিফ হোসেন, শামীম হোসেন, সৌম্য সরকার; তালিকায় আছে আরও অনেকের নাম। এদের কেউ একজন ভালো করতে পারলেই লাল-সবুজ জার্সিতে মাহমুদউল্লাহ অধ্যায় শেষ হয়ে যেত। এমনকি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একাদশে রাখার পরের ম্যাচে আবার বাদ দেওয়া হয় তাকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে তাকে বাদ দেওয়ার কারণ ছিল না।
কখনও কখনও কারও নিয়তি ভিন্নভাবে লেখা হয়। অনেক দুঃখ সয়ে, পরিশ্রম আর ধৈর্যের মিশেলে কেউ যখন নিজেকে গড়ে তোলেন, তাকে সাময়িক থামানো গেলেও দমিয়ে রাখা যায় না। মেঘের পরে রোদ হয়ে ঠিকই আলো ছড়ান। মাহমুদউল্লাহর গল্পটাও কি এমন নয়? যার সুযোগই পাওয়ার কথা ছিল না, তিনিই কি না চলতি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। রান উৎসবের আসরে ব্যাটিংয়ে ভুগতে থাকা দলের মাঝি হয়ে টেনে নিয়েছেন।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক মাহমুদউল্লাহ। একমাত্র শতক তারই। তার প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ হবে রান স্বর্গ। সেখানে মাহমদউল্লাহ স্লো স্ট্রাইক রেট নিয়ে কতটা কী করতে পারবে। অথচ, আসর শেষে তানজিদ তামিমের পর সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট তারই।
আট ম্যাচ খেলেছেন। ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন সাতটিতে। একটি শতক ও একটি অর্ধশতকে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩২৮ রান করেছেন। স্ট্রাইক রেট ৯১.৬২। গড় ৫৪.৬৬। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১১১ বলে ১১১ রানের ঝলমলে ইনিংসটা বহুদিন মনে রাখবে ক্রিকেটপ্রেমীরা। গোবরে পদ্মফুল যেন তিনি। সে ম্যাচে ৫৮ রানে পাঁচ উইকেট হারানো দলের রান ২৩০ এর ওপর নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মাহমুদউল্লাহ আউট হওয়ার পর একটা ওভার টিকতে পারেনি বাংলাদেশ, পারার কথাও নয়। তাকে সবসময় লেজের ব্যাটারদের নিয়ে লড়ে যেতে হয়েছে। নামতে হয়েছে এমন সময়ে, চাইলেও কিছু করার থাকে না। তবু, যতবার সুযোগ পান, নিজেকে মেলে ধরেন ততবার।
নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ৪৯ বলে অপরাজিত ৪১, ভারতের সঙ্গে ৩৬ বলে ৪৬, পাকিস্তানের সঙ্গে ৭০ বলে ৫৬ রান করেন। আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এটিই হতে চলেছে তার শেষ বিশ্বকাপ। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৮ বলে ৩২ রার করে রানআউট হন। যে দুর্ভাগ্য তার ক্যারিয়ারের সঙ্গী, শেষাংশে এসেও আরেকবার উঁকি দিয়ে গেল।
দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করেই নিজের কাজ করে গেছেন। ওপরে একজন আছেন, যিনি সয়ে যাওয়াদের ক্ষয়ে যেতে দেন না। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শতকের পর মাহমুদউল্লাহ যেন ইশারায় সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। প্যাভিলিয়ন থেকে সবাই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, মাহমুদউল্লাহ হাত নেড়ে ও আঙুল উঁচিয়ে বোঝাতে চাইলেন, আমাকে কৃতিত্ব দিও না। সব সৃষ্টিকর্তার কৃপা।
মাহমুদউল্লাহ, বাংলার ক্রিকেটে আপনি দুঃখী রাজপুত্র হয়েই থাকবেন চিরকাল। আপনাকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। বিশ্বকাপজুড়ে মাহমুদউল্লাহ হয়ত আনমনে গেয়েছিলেন–
‘তোমাকে সাজাব বলে কোটি কথা করি জমা
আশা রাখি দেখা হবে শুভ রাত্রি প্রিয়তমা!’
বাংলাদেশ তো তার প্রিয়তমার মতোই। অভিমানের স্রোত বইলেও ফিরে এসেছেন। মাঝ নদীতে খেই হারানো তরীর হাল ধরেছেন।