কোহলি-শামির রেকর্ডে ফাইনালে ভারত
ম্যাচের আগে ফেভারিট ধরা হয়েছিল ভারতকেই। ব্যাটিংটাও তারা করেছে সেরার মতোই। ভারতীয় ব্যাটারদের রানের পাহাড়ে শুরুতেই পিছিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। কিউই বোলারদের তুলোধুনো করে ৩৯৭ রান সংগ্রহ করেন কোহলি-রোহিতরা। তবে, দলটি নিউজিল্যান্ড বলেই জমজমাট এক ম্যাচের প্রত্যাশায় ছিল সবাই। সেটি হয়েছেও। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে দাঁতে দাঁত চেপে। কিন্তু, রান পাহাড় আর ডিঙানো হয়নি। ভারত পায় ৭০ রানের জয়। প্রথম দল হিসেবে নিশ্চিত করে চলতি আসরের ফাইনাল।
আগে ব্যাট করে ৫০ ওভারে চার উইকেট হারিয়ে ৩৯৭ রান করে ভারত। জবাবে ৪৮.৫ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে কিউইরা থামে ৩২৭ রানে।
ভারতের ছুঁড়ে দেওয়া ৩৯৮ রানের পাহাড়সম রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় তারা। ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলে দলীয় ৩০ রানে ভাঙে কিউইদের ওপেনিং জুটি। ৩৯ রানে যায় দ্বিতীয় উইকেট। ১৫ বলে তিন চারে ১৩ রান করা ডেভন কনওয়েকে ফিরিয়ে বল হাতে ভারতকে প্রথম সাফল্য এনে দেন মোহাম্মদ শামি। উইকেটের পেছনে লোকেশ রাহুলের ক্যাচ বানিয়ে কনওয়েকে সাজঘরে ফেরান শামি। ভারত পায় ব্রেক থ্রু। ভারতের বোলিংয়ের সামনে ধুঁকতে থাকা কিউইদের দ্বিতীয় উইকেটও শিকার করেন শামি। রাচিন রবীন্দ্র আউট হন ২২ বলে ১৩ রান করে। তাকেও তালুবন্দি করেন রাহুল।
দ্রুত দুই উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা কিউইরা ম্যাচে ফেরে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ও ডেরিল মিচেলের ব্যাটে। দুজন মিলে দলীয় সংগ্রহ শতরান ছাড়িয়েছেন। ভারতীয় বোলারদের খেলছেন দেখেশুনে। ১৮১ রানের জুটি গড়েন দুজন মিলে। মাঝে অবশ্য দুবার জীবন পেয়েছেন উইলিয়ামসন।
একবার জসপ্রীত বুমরাহর বলে ক্যাচ ছেড়েছেন মোহাম্মদ শামি। আরেকবার রান আউটের হাত থেকে বাঁচেন লোকেশ রাহুলের ভুলে। বলের স্পর্শ পাওয়ার আগে গ্লাভস দিয়ে স্ট্যাম্প ভাঙেন উইকেটরক্ষক রাহুল। ঝুঁকি না নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করে খেলছিলেন উইলিয়ামসন। তবে, ৭৩ বলে ৬৯ রান করে স্কয়ার লেগে একদম সীমানা প্রান্তে সূর্যকুমার যাদবের ক্যাচে পরিণত হন উইলিয়ামসন। তাকেও আউট করেন শামি। দ্বিতীয় স্পেলে এসে দলকে ব্রেক থ্রু এনে দেন তিনি। একই ওভারে টম লাথামকে লেগ বিফোর করে ভারতকে ম্যাচে ফেরান শামি। সব মিলিয়ে ম্যাচে ৫৭ রান দিয়ে সাত উইকেট শিকার করেন শামি। ৫৭ রানে সাত উইকেট নেন শামি, ওয়ানডে বিশ্বকাপে পঞ্চম বোলার হিসেবে এক ইনিংসে সাত উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন তিনি। তার আগেএ কীর্তি ছিল মাত্র চারজনের।
সেখানেই ভেঙে যায় কিউইদের মনোবল। এরপর একা লড়াই চালিয়ে যান মিচেল। ১১৯ বলে নয়টি চার ও সাতটি ছক্কায় ১৩৪ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন তিনি। ডিপ মিড উইকেটে তাকে জাদেজার ক্যাচ বানিয়ে ফেরান শামি। মিচেলের উইকেটের মধ্য দিয়ে ম্যিাচে শামি তুলে নেন ফাইফার। মিচেল আউট হওয়ার পর আর টিকতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। থেমে যায় ৩২৭ রানে। টানা দুই ফাইনাল খেলার পর এবার শেষ চার থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে কেন উইলিয়ামসনের দলকে। আর ১২ বছর পর আবারও ফাইনালে উঠেছে ভারত।
শামির সাত উইকেটের পাশাপাশি বুমরাহ, সিরাজ ও যাদব পান একটি করে উইকেট।
দিনের শুরুতে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেয় ভারত। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা ভারত শুরুটা করেছে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। দুই ওপেনার অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল মিলে আগ্রাসী ভঙ্গিতে শুরু করেছে কিউইদের বিপক্ষে। ৮.২ ওভারে ৭১ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়ে ভারত। টিম সাউদির বলে লং অনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রোহিত। কেন উইলিয়ামসনের ক্যাচে পরিণত হওয়ার আগে ২৯ বলে ৪৭ রান করেন তিনি। রোহিত ফিরে গেলেও আরেক ওপেনার শুভমান গিল চড়াও হন নিউজিল্যান্ড বোলারদের ওপর। দুরন্ত ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু, ৬৫ বলে ৭৯ রান করে চোটের শিকার হন গিল। মাঠ ছাড়েন রিটায়ার্ড হয়ে। তার ইনিংসটি সাজানো ছিল আটটি চার ও তিনটি ছয়ে। বিরাট কোহলির সঙ্গে ৯৩ রানের জুটি গড়েন গিল। পরে অবশ্য শেষ ব্যাটার হিসেবে মাঠে নামেন তিনি। অপরাজিত থাকেন ৬৬ বলে ৮০ রানে।
গিল ক্রিজ ছাড়ার পর কোহলিকে সঙ্গ দেন শ্রেয়াস আইয়ার। দুরন্ত ব্যাটিংয়ে ৭০ বলে চারটি চার ও আটটি ছক্কায় ১০৫ রান করে আউট হন শ্রেয়াস। ট্রেন্ট বোল্টের বলে শ্রেয়াসের ক্যাচ নেন মিচেল স্যান্টনার। লোকেশ রাহুল অপরাজিত থাকেন ২০ বলে ৩৯ রানের ক্যামিও খেলে।
এর আগে পরে পুরো সময়টাই কোহলিময়। একটি কিংবা দুটি নয়, এক ম্যাচে তিনটি রেকর্ড গড়লেন কোহলি। ১১৩ বলে ১১৭ রান করেন কোহলি। নয়টি চার ও দুই ছয়ে সাজানো ইনিংসটির মাহাত্ম্য হয়তো তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি। ওয়ানডেতে এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এতদিন ছিল শচীনের দখলে। ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীনের করা ৬৭৩ রানের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন কোহলি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আজকের ম্যাচে ব্যক্তিগত ৮০ রানের সময় শচীনকে পেছনে ফেলেন তিনি। এরপর পূর্ণ করেন শতক। চলতি বিশ্বকাপে এটি কোহলির তৃতীয় সেঞ্চুরি। আর ক্যারিয়ারের ৫০তম।
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ৫০ শতক পূর্ণ করলেন তিনি। ভাঙলেন শচীনের ৪৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড।
ম্যাচে ১০২ থেকে ১০৬ রানে কোহলি পৌঁছান চার মেরে। তাতেই গড়েছেন আরেকটি রেকর্ড। যে রেকর্ডে তিনি একমাত্র ক্রিকেটার। আজকের ম্যাচ শুরুর আগে এই বিশ্বকাপে কোহলির রান ছিল ৫৯৪। ১০৬ রানের সময় স্পর্শ করেন ৭০০ রানের মাইলফলক। ওয়ানডেতে এক বিশ্বকাপে ৭০০ রান নেই আর কারও। বর্তমানে তার রান ৭১১।
কোহলির দিনে ভারতও পায় ৩৯৭ রানের বিশাল সংগ্রহ। ২০১১ বিশ্বকাপে সর্বশেষ ফাইনালে উঠেছিল ভারত। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। এবার ঘরের মাঠে তাদের সামনে আবারও সুযোগ ফাইনালে ওঠার।
স্বভাবতই পাত্তা পায়নি কিউই বোলাররা। টিম সাউদি তিন উইকেট পেলেও দিয়েছে বরাবর ১০০ রান। এক উইকেটের বিনিময়ে বোল্ট দেন ৮৬ রান।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত : ৫০ ওভারে ৩৯৭/৪। (রোহিত ৪৭, গিল ৮০*, কোহলি ১১৭, শ্রেয়াস ১০৫, রাহুল ৩৯*, যাদব ১; বোল্ট ১০-০-৮৬-১, সাউদি ১০-০-১০০-৩, স্যান্টনার ১০-১-৫১-০, ফার্গুসন ৮-০-৬৫-০, রাচিন ৭-০-৬০-০, ফিলিপস ৫-০-৩৩-০)
নিউজিল্যান্ড : ৪৮.৫ ওভারে ৩২৭/১০। (কনওয়ে ১৩, রাচিন ১৩, উইলিয়ামসন ৬৯, মিচেল ১৩৪, লাথাম ০, ফিলিপস ৪১, চ্যাপম্যান ২, স্যান্টনার ৮, সাউদি ৯, বোল্ট ২*, লোকি ৬; বুমরাহ ১০-১-৬৪-১, সিরাজ ৯-০-৭৮-১, শামি ৯.৫-০-৫৭-৭, জাদেজা ১০-০-৬৩-০, যাদব ১০-০-৫৫-১)
ফল : ভারত ৭০ রানে জয়ী।