ফিরে দেখা ২০২৩ : ক্রিকেটে প্রাপ্তি ছাপিয়ে ঘটনাবহুল বছর
ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। প্রতিটি মুহূর্তেই জীবন থেকে একটি একটি করে সেকেন্ড হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি পরিসমাপ্তির পথে ২০২৩। পুরনো স্মৃতিকে পেছনে ফেলে নতুন বছরের দিকে ধাবিত হওয়ার অপেক্ষায় গোটা বিশ্ব। ক্রীড়াঙ্গনের সব হিসেবে-নিকেশও শুরু হবে নতুন করে। নিজেদের ভুল ত্রুটি শুধরে নতুন শুরুর অপেক্ষায় ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো। সেই তালিকায় থাকা বাংলাদেশও নিজেদের সক্ষমতা আর দাপটে অভিপ্রায় ঘটাতে মরিয়া।
চলতি বছর তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৫০ ম্যাচ খেলে ২৪টিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে ৪৪ ম্যাচে ২১ জয় ছাপিয়ে যা নতুন রেকর্ড। কিন্তু বিশ্বকাপ–ব্যর্থতায় সেই সাফল্য উদযাপন করার পথ রাখেনি। তবুও বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই বছরটি কেমন কাটল দেখে নেওয়া যাক এক নজরে...
চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রত্যাবর্তন: বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম আলোচিত চরিত্র লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। প্রথম দফায় নজরকাড়া সব সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্ক সঙ্গী করেই বাংলাদেশ অধ্যায় শেষ হয় হাথুরুসিংহের। দ্বিতীয় দফায় ফের বাংলাদেশ ক্রিকেটে আসবেন তিনি, সেটা ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। তবে, গত ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে বিসিবি।
সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ধবলধেলাই
বিপিএলের কারণে ২০২৩ এ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ খেলতে নামে মার্চ মাসে। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারলেও টি-টোয়েন্টিতে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করে ছাড়ে স্বাগতিকরা। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে এমন ধবলধেলাই নিঃসন্দেহে দেশের ক্রিকেটে বড় প্রাপ্তি।
সাকিব আল হাসানের দুবাইকাণ্ড: চলতি বছরের মার্চে দুবাইতে পুলিশ খুনের পলাতক আসামী আরাভ খানের জুয়েলারির দোকান উদ্বোধনে গিয়ে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তদন্তের স্বার্থে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় সাকিবকে।
৮৯ বছরের মধ্যে সাদা পোশাকে বৃহত্তম জয়ের রেকর্ড
জুনে মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানকে গুড়িয়ে ৫৪৬ রানের বিশাল জয় পায় বাংলাদেশ। যা শুধু বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাস নয়, বরং ১৪৬ বছরের ইতিহাসে রানের দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়। ১৯৩৪ সালের পর এটাই সবচেয়ে বড়।
তামিম ইকবালের নাটকীয় অবসর ও প্রত্যাবর্তন
জুলাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের মাঝপথে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে হুট করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেন ওপেনার তামিম ইকবাল । ভক্ত-সমর্থকদের মতো দেশসেরা ওপেনারের এমন আচমকা অবসর মেনে নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদিন পরই গনভবনে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের উপস্থিতিতে অবসর ভেঙে ফেরার ঘোষণা দেন তামিম।
১১ বছর পর এশিয়া কাপে ভারত বধ : ২০১২ সালে হোম অব ক্রিকেট মিরপুরে মুশফিক-সাকিবদের নৈপুণ্যে ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনাল নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ। মাঝে প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ভারতকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে হারাতে পারেনি লাল-সবুজের দল। সাকিব-মুস্তাফিজদের হাত ধরে সেই আক্ষেপ মিটেছে অবশেষে। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে নাটকীয় জয় তুলে নেয় চন্ডিকা হাথুরুসিংহের শিষ্যরা। যদিও ফাইনালে যেতে পারেনি শান্ত-মিরাজরা।
বিশ্বকাপের আগে সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব
২৬ সেপ্টেম্বর—দিনটি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম ঘটনাবহুল দিন। দিনভর নানা নাটকীয়তার পর ওয়ানডে বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করা হলেও সেই দলে সুযোগ পাননি দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। পুরোপুরি ফিট না থাকায় তামিমকে বিশ্বকাপের জন্য বিবেচনা করেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে একটি বেসরকারি টিভিতে সাকিব ও নিজের ফেসবুক পেজে তামিম ভিডিওবার্তা দেয়। দুই ক্রিকেটারের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রূপ নেয় ‘টক অব দ্য টাউনে’। যা পরবর্তীতে মাঠের পারফরম্যান্সেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।
হতাশার ওয়ানডে বিশ্বকাপ : ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ বরাবরই সমীহ জাগানিয়া দল। ভারতের মাটিতে খেলা হওয়ায় বাংলাদেশকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধে সমর্থকরা। তবে, সামথ্যের্র ছিটেফোঁটাও পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৯ ম্যাচ খেলে আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া আর কোনো ম্যাচেই জিততে পারেনি চন্ডিকা হাথুরুসিংহের শিষ্যরা।
সংগ্রামী মাহমুদউল্লাহর রাজকীয় প্রত্যাবর্তন
‘সাইলেন্ট কিলার’ তকমা তো আগেই পেয়েছিলেন। তার যথার্থতা আরও একবার প্রমাণ করলেন বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে। ৫৪.৬৬ গড় আর ৯১.৬ স্ট্রাইক রেটে ৭ ম্যাচে করেন ৩২৮ রান। দলের হয়ে একমাত্র সেঞ্চুরিয়নের মালিকও তিনি। আসরজুড়ে হতাশার সাগরে ডুবে থাকা দলে আশার আলোটা জ্বালিয়েছিলেন রিয়াদই। যদিও বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেতে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে।
নারী ক্রিকেটের জাগরণ
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটারদের জন্য ২০২৩ স্মরণীয় এক বছর। চলতি বছরের শুরুতে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয় ও ওয়ানডে সিরিজ ড্র—দুটোই বড় অর্জন। জয় এসেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজেও। প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সাদা বলের দুই সংস্করণেই জয়ের দেখা পেয়েছে নিগার সুলতানার দল।
সাকিবদের আক্ষেপ ঘুচিয়ে যুবাদের এশিয়া জয়
২০১২, ২০১৬ ও ২০১৮ তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেও অধরা শিরোপা জেতা হয়নি সাকিবদের। বারবার ফাইনাল হারের সেই আক্ষেপ এবার কিছুটা হলেও মিটেছে। চলতি মাসে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের হাত ধরে প্রথমবারের মতো যুব এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। যা ২০২৩ এ দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
সাদা বলে কিউইদের মাটিতে ইতিহাস : নিজেদের ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে হারানো অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বাংলাদেশের জন্য। অন্তত গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান তে সে কথাই বলে। তবে, ২০২২ সালে প্রথমবার কিউইদের মাটিতে টেস্ট ফরম্যাটে জিতলেও ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে জয় ছিল অধরা। এবার সেই আক্ষেপও মিটিয়েছে লাল-সবুজের দল। সিরিজ জিততে না পারলেও ইতিহাস গড়ে নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতেই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে হারিয়েছে বাংলাদেশ। যা দেশের ক্রিকেটে চলতি বছর বড় অর্জন বটে।