মাহমুদউল্লাহ : কন্যাসুন্দর আলোয় গড়ে ওঠা চিত্রকর্ম
চীনা দার্শনিক সান জু’র একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করা যাক— ‘যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কৌশল হচ্ছে লড়াই না করেই শত্রুকে পরাজিত করা।’ বাইশ গজ যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেখানে আপন ঘরেই পর হয়ে গেছেন। অসংখ্য যুদ্ধে একসঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ দেখলেন, তার ঘরে ফেরার পথ বন্ধ। তিনি ঠাঁই নিলেন নিরবতা নামক এক মহা অস্ত্রাগারে। মৌনতা না কি সম্মতির লক্ষণ! মাহমুদউল্লাহ তার নিরব অস্ত্রেই হয়তো বুঝিয়েছেন, তোমরা যা ভাবছো, যা করছো; তা-ই হোক। দেখি কতদূর যেতে পারো আমায় ছাড়া।
বলে রাখা ভালো, মাহমুদউল্লাহকে ব্রাত্য করা সেই ঘরের শত্রু বিভীষণ আর কেউ নয়, খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে কখনোই লাল-সবুজের জার্সিতে তিনি অটোচয়েজ ছিলেন না। ছিল না তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। অথচ তিনিসহ গড়ে ওঠা পঞ্চপাণ্ডবের বাকি চারজনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কেবল দেখেই গেছেন। কথায় বলে, তোমার যা কিছু প্রাপ্য, তা পাবে। আজ নয়তো কাল অথবা পরশু। কিন্তু, পাবেই।
অপেক্ষায় ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। ভরাডুবির পর জায়গা হয়নি পরের আসরে। সময়ের কী দুরন্ত রসিকতা, এবার তিনি দলে ‘অটোচয়েজ!’ এভাবেই বোধকরি ফিরে আসে অপেক্ষার ফল, এভাবেই সম্ভবত একটি চারাগাছ বৃক্ষ হয়ে ওঠে। শুধু কালবৈশাখীর সময়ে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়। হেলে পড়লেও ফের সটান উঠে দাঁড়াতে হয়।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে—‘ইটস নট ওভার টিল ইটস ওভার।’ শেষের আগে শেষ নয়। শেষ বলে আদতে কিছু নেই। যখন যেখানে সুযোগ পাবেন, সেখান থেকেই নতুন শুরুর গল্প রচিত হয়। মাহমুদউল্লাহ যদি বই হতেন, অপরাহ্নের গল্পে তাকে নিয়ে অনায়াসে একটা নতুন অধ্যায় লেখা যেত। বিকেলের নিভু নিভু কন্যাসুন্দর আলোর মাঝে যেভাবে শহরজুড়ে কৃত্রিম আলোরা জেগে উঠে তৈরি করে অদ্ভুত সুন্দর মুহূর্ত, মাহমুদউল্লাহর প্রতিবার ফিরে আসার চিত্রটাও এমনই।
গত ওয়ানডে বিশ্বকাপেই ঘটেছিল পুনর্জন্ম। ভরাডুবির বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে একাই বাঁচিয়েছেন বাংলাদেশের মান। এরপর বিপিএল। ফরচুন বরিশালের হাতে শিরোপা তুলে দেওয়ার অন্যতম কারিগর মাহমুদউল্লাহ আলো ছড়ান জিম্বাবুয়ে সিরিজেও। যেন তিনি ফিনিক্স পাখি। তাকে অনায়াসে রূপকথার পঙ্খীরাজ বলা যাবে, মুখে না বললেও যার পিঠে চেপে বহুদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে লাল-সবুজের দল।
আমরা অদৃষ্টে বিশ্বাস করি অনেকে। কারও বিশ্বাস পরিশ্রমে। কেউ স্রষ্টার হাতে সব ছেড়ে দেন। জীবনকে একেকজন একেকভাবে দেখে। সবার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। ভিন্নতার মাঝে আমরা কোনো এক বিন্দুতে মিলিত হই। সেখানে ভেদাভেদ নেই। দুঃখগুলো এক, না পাওয়ার গল্পগুলো এক, ব্যর্থতার অভিন্ন বৃত্তে আটকে পড়ার নিয়তিও এক। ভাবনার জগতে যার গতি সম্ভবত আলোর চেয়ে বেশি। নেতিবাচক ভাবনা উঁকি দিলেও মানুষকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঠিক ব্যবহার জানতে হয়। বর্তমানকে ফেলে না রেখে কাজে লাগাতে জানলে জীবন সুন্দর। মাহমুদউল্লাহ সেটিই করেছেন। বাদ পড়ার দিনগুলোতে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল না অভিমান। নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ ছিল মনে মনে। পরিশ্রম আর একাগ্রতার মিশেলে করেছেন তা। পরিশ্রম এমন এক জমি, হাজারবার চাষেও এতটুকু ফলন কমে না। বরং, পরিণত হয় সোনালি ফসলে।
৩৭ বছরে এসে যখন ব্যাট-প্যাড গুটিয়ে রাখার কথা, তখন মাহমুদউল্লাহ গুছিয়ে নিলেন। বিশ্বকাপের বিমানে চড়তে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। নিজে তো এগিয়ে আছেনই। মার্কিন মুলুক থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ— এবার ওড়াতে হবে লাল-সবুজের বিজয় নিশান।