ব্যালনের তেতো রাতে জীবনের মিষ্টি স্বাদ পেয়েছেন ভিনি
‘শিল্প টিকে থাকে, কারণ জীবন যথেষ্ট নয়!’—কথাটি ব্রাজিলের বিখ্যাত লেখক ও সমালোচক ফেরেইরা গুলারের। ব্রাজিলের আরেক লেখক ও গায়ক ভিনিসিয়াস দে মরিয়েস বলেছিলেন, ‘জীবন হচ্ছে প্রতিরক্ষার এক কৌশলগত শিল্প। যদিও এখানে অনেক সময় মতের অমিল থাকে।’ দুজনের কথার মাঝে সংযোগ সেতু স্থাপন করতে পারেন আরেক ব্রাজিলিয়ান, তিনি ভিনিসিয়াস জুনিয়র। প্রথম দুজনের মতো তিনি কালি ও কলমে নয়, মেতেছেন সবুজ ঘাসে, ফুটবল নামক ক্যানভাসে। নিজের মতো এঁকে গেছেন একের পর এক শিল্প।
ভিনিসিয়াস জুনিয়র নিজেকে প্রবোধ দিতে পারেন তার দেশের দুই বিখ্যাত ব্যক্তির কথা থেকে। নিজেকে বোঝাতে পারেন, যেমনটা তারা বোঝাতে চেয়েছেন। মানুষ চলে যায়, রয়ে যায় কর্ম। জীবনে আঘাত আসবে, নিজেকে বাঁচাতে হবে। কখনও কখনও সেই আঘাতের পাল্টা জবাব দিতে চাইলেও নিজের সঙ্গেই লড়তে হবে। হতে হবে পোক্ত। এই যেমন, প্যারিসের থিয়েটার দ্যু শাতলের আলো ঝলমল রাতটা হতে পারত ভিনিময়, হয়নি। বিনিময়ে দুঃখ পেয়েছেন তিনি। বিপদেই না কি বন্ধুর পরিচয়। রিয়াল মাদ্রিদ সেটি প্রমাণ করেছে।
ভিনিসিয়াসকে অন্যায়ভাবে ব্যালন ডি’অর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে—এমন ভাবনা ও ভিনির প্রতি সমর্থন থেকে পুরো রিয়াল মাদ্রিদ কর্তৃপক্ষ শেষ বেলায় বয়কট করেছে ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানকে। মাদ্রিদ থেকে প্যারিসের ফ্লাইট ধরার কথা ছিল প্রায় ৫০ জনের। কিন্তু, ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ থেকে শুরু করে কোচ আনচেলত্তি, তার শিষ্যরা কেউই যাননি প্যারিসে। ব্যালন ডি’অরের রাত আর সেখানে নেই বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত ফুটবল ক্লাবের কোনো প্রতিনিধি—রদ্রির প্রথম ব্যালন জয়ের চেয়ে বেশি আলোচনায় তো ছিল এটিই। এমন সাহস দেখানোর দুঃসাহসও তো হয়ে ওঠেনি কারও।
থিয়েটার দ্যু শাটলে মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) রাতে সবই ছিল। তবু, ছিল না পূর্ণতা। প্রায় কানায় কানায় ভর্তি অডিটোরিয়ামের কিছু অংশ খালি ছিল। যে অংশটুকুর শূন্যতা ঢাকেনি ভরপুর তারকাতেও। ওই যে, রিয়াল মাদ্রিদের কেউ ছিল না ব্যালন ডি’অর ২০২৪ এর আয়োজনে!
আর ভিনিসিয়াস! সে স্তব্ধ হয়ে গেছে বোধহয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সোচ্চার হওয়া ভিনি মেনে নিয়েছেন অনাচার। রদ্রির চেয়ে ভিনি এগিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে, এ তো দুনিয়ার তাবড় তাবড় ফুটবল বিশেষজ্ঞরাই বলছিলেন। তিনিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, ব্যালন ডি’অরের সোনালি গোলক উঠছে তার হাতেই। মাদ্রিদ শহরেরই এক মহান দার্শনিক হোসে ওর্তেগা বহুকাল আগে বলে গিয়েছিলেন—‘মানুষকে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ করে তোলে তার কল্পনাশক্তি।’
ভিনিসিয়াস হোসে পাইশাও দে অলিভিয়েরা জুনিয়র—২৪ বছরের টগবগে এক যুবক সাত বছর আগে পাড়ি জমান মাদ্রিদে। ব্রাজিলের ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো থেকে প্রথমে মাদ্রিদের যুব দল, তারপর ২০১৮ তে মূল দলে। সেই বছরই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ক্লাব ছাড়েন। হাল ধরেন করিম বেনজেমা। ভিনি সুযোগ পান, গোল মিস করেন। তার সহজ গোল মিসে খোদ মাদ্রিদ ভক্তরা বিরক্ত হতো। কিন্তু, ওই যে কল্পনাশক্তি। বেনজেমার উত্থান দেখেছেন চোখের সামনে, সাদা জার্সির তারার হাটে নিজেও কি একদিন তারকা হতে চাননি? চাওয়া স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে গায়ে চাপে রোনালদোর বিখ্যাত জার্সি নম্বর সেভেন।
সাত নম্বর জার্সির মান রাখতে হেবে, নিজেকে বদলাতে থাকেন ভিনিসিয়াস। যত ছন্দে ফেরেন, বর্ণবাদের দ্বন্দ্বে ফেঁসে যান। বারবার বিদ্ধ হয়েও সয়ে গেছেন। নিজেকে শানিত করেছেন। কালোমানিক পেলের দেশের ছেলে, সহজে কি হার মানে! ২০২৩-২৪ মৌসুমটা নৈবেদ্যের থালা সাজিয়ে বসে ভিনির জন্য। দু’হাত ভরে তা গ্রহণ করেন। সবকিছু ওলটপালট করে সবুজ ঘাসে আঁকেন সাদা প্রতিমা।
রিয়ালের জার্সিতে ৩৯ ম্যাচে মাঠে নামেন। ২৪টি গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট, সরাসরি ৩৫ গোলে সহায়তা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ম্যাচ সেরা। লস ব্লাংকোদের লা লিগা ও রেবর্ড ১৫তম লিগ জয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান কোনো সন্দেহ ছাড়াই। নতুন মৌসুমেও টেনে নিলেন ছন্দ। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে ধসিয়ে দিলেন ৪৫ মিনিটের এক শৈল্পিক প্রদর্শনীতে। ব্যালন ডি’অর গালা নাইটের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার এমন ফর্মে সব শঙ্কা কেটে যায়। সোনালি গোলকে চুমুর স্বাদ ভিনিই নেবেন।
চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মিল সবসময় হয় না। অনুপমের গানের মতো, সব পেলে নষ্ট জীবন। এবার তাই স্বাদ নেওয়া হয়নি। জানা হয়নি আলো ঝলমল রাতে সেরাদের সেরা হওয়ার পর কেমন লাগে। তাই বলে জীবন থেমে থাকে?
হোসে ওর্তেগার আরও একটি কথা দিয়েই ইতি টানা যাক। শেষ মানে তো নতুন শুরু। ব্যালনের স্বাদ না পাওয়া ভিনির মুখেও নিশ্চয়ই তিক্ততা থাকবে না বেশিদিন। ওর্তেগা বলেছিলেন, ‘আমি ও আমার পরিস্থিতি—যদি আমি তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, আমি নিজেকে বাঁচাতে পারব না।’ ভিনি নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। গোটা মাদ্রিদ দল তার পাশে দাঁড়িয়ে ইতোমধ্যে রাতটা তারই করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সারা বিশ্ব জুড়ে পেয়েছেন ভক্ত ভালোবাসা। এই তৃপ্তি নিয়ে নতুন সকালে ঝলক দেখানোর প্রতিজ্ঞা তো করতেই পারেন।