পেশা হিসেবে ইউটিউব ভিডিও স্ক্রিপ্ট রাইটিং বেছে নিতে যা প্রয়োজন
শুধুমাত্র বিনোদন প্রদানের ভনিতায় আবির্ভূত ইউটিউব নামটি এখন দিনযাপনের অর্থ। তাই একে ঘিরে মৌলিক চাহিদার কথা চিন্তা করা যুগের সহজাত ধারণা। মুঠো ভরা তথ্যের ওপর সামাজিক মাপকাঠির নির্ভরশীলতা তথ্যকে পরিণত করেছে পণ্যে। আর এরই নিরিখেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে প্রজন্মের সেরা ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব কেন্দ্রিক পেশাগুলো। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কন্টেন্ট ভিডিও, আর তার প্রধান কাঁচামালের যোগান দেয় স্ক্রিপ্ট রাইটাররা। তাই ইউটিউব ভিডিওর স্ক্রিপ্ট রাইটিং এবং এর প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের নিবন্ধ। চলুন, এই সৃজনশীল পেশার নানা দিক সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
স্ক্রিপ্ট রাইটিং কী
স্ক্রিপ্ট রাইটিং বা পান্ডুলিপি লিখন হলো ভিডিওর মাধ্যমে দেখানোর জন্য নির্ধারিত তথ্যগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে লেখা। প্রতিটি দৃশ্যে ক্রমান্বয়ে যা যা দেখানো, শোনানো এবং বোঝানো হবে, তার সামগ্রিক লিখিত রূপ হচ্ছে স্ক্রিপ্ট।
পাঠ্য, স্থির চিত্র, ও চলচ্চিত্রসহ যাবতীয় কন্টেন্টের সংমিশ্রণ স্পষ্টভাবে লেখা হয় এতে। মূলত ছকে বাঁধা লেখাগুলো অনুসরণ করেই চূড়ান্ত ভাবে নির্মাণ করা হয় কন্টেন্ট।
এর আরেক নাম চিত্রনাট্য বা স্ক্রিনরাইটিং, যেটা সাধারণত মুভি বা মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে, এর পরিধি টিভি নাটক, গেমস, তথ্যচিত্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি, রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও লেখা হয়ে থাকে পান্ডুলিপি।
ভিডিও স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনীয়তা
একটি পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট আপনার চিন্তাভাবনা এবং ধারণাগুলোকে সুসংগঠিত করতে পারে। এতে করে পূর্ব পরিকল্পিত ও প্রাসঙ্গিক কোনও তথ্য বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
গুছিয়ে কথা বলা
আগে থেকে একটি স্ক্রিপ্ট ভালভাবে সম্পন্ন হয়ে গেলে সেটার ওপর সময় নিয়ে কথা বলার চর্চা করা যায়। এভাবে চূড়ান্ত ভিডিওর সময় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কথা বলার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ফলে কন্টেন্টের গুণগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি কথা বলা রেকর্ডিং-এও সময় কম প্রয়োজন হয়।
সময়ের হিসাব
একটি নিক্ষুত স্ক্রিপ্টে প্রতিটি দৃশ্যে নির্ধারিত কথাগুলো বলার জন্য সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। প্রতিটি দৃশ্য আলাদা করে রেকর্ড করার সময় পুনঃ পুনঃ অনুশীলনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়টি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে করে পুরো কারিগরি রক্ষণাবেক্ষণের বেলায়ও সময়ের হেরফের হয় না।
ধারাবাহিকতা বজায়
যেকোনো কন্টেন্টের ক্ষেত্রেই একটি সুস্পষ্ট কাঠামো তার গুণগত মান বৃদ্ধির পরিচায়ক। ভিডিওর ক্ষেত্রেও এর স্ক্রিপ্ট বিভিন্ন ফুটেজ, শব্দ, স্থিরচিত্র, ও স্পেশাল ইফেক্ট সহ প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণতা নিশ্চিত করে।
ইউটিউব ভিডিওর জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটিং
বর্তমান সময়ে সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেকটা এগিয়ে ইউটিউব। নাটক-সিনেমার মানের জন্যও এখন গুরুত্ব দেওয়া হয় লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারকে, যেগুলো মূলত এই প্ল্যাটফর্মের প্যারামিটার।
নেটিজেনদের উদ্দেশ্য করে এখন মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের কন্টেন্ট। তাই সঙ্গত কারণেই এগুলোর জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটারদের চাহিদা বাড়ছে। শুধুমাত্র ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম নির্ভর লেখালেখিই পরিণত হয়েছে স্বতন্ত্র এক পেশায়।
নিউজ ও পাবলিশিং কোম্পানি, তথ্যচিত্র নির্মাতা, ব্লগার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্র্যান্ড প্রোমোশনের জন্য তৈরি করছে ইউটিউব চ্যানেল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে পান্ডুলিপি লেখকদের চাহিদা।
ইউটিউব ভিডিও স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা-সৃজনশীলতা
সৃজনশীলতা হলো সম্পূর্ণ অভিনব ধারণার অবতারণা করা। অন্যান্য চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক চ্যানেল মালিকের নতুন নতুন কন্টেন্ট বানানোর প্রবণতা থাকে। আর তখনই তাদের সরণাপন্ন হতে হয় পান্ডুলিপি লেখকদের। নতুন ধারণা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট রাইটারদের খেয়াল রাখতে হবে যে, বিষয়বস্তু দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে কি না। প্রকৃতপক্ষে, এই চিত্তাকর্ষণের জায়গাতেও তাদেরকে সৃজনশীল হতে হবে।
গবেষণা ও বিশ্লেষণ
তথ্য হচ্ছে স্ক্রিপ্টের মূল জীবনী শক্তি। তাই লেখকদের সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণী ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস খুঁজে বের করা, অতঃপর সেই তথ্যের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ যাচাইও এই দক্ষতার অন্তর্ভূক্ত।
গল্প বলা
এটি এমন এক দক্ষতা যা প্রতিটি লেখকেরই থাকা আবশ্যক। লেখা পড়েই যদি কোনো পাঠকের গল্প শোনার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তাহলেই কন্টেন্ট সফল হওয়ার অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। বাকিটুকু থাকে কারিগরির জায়গাতে। জটিল রকেট সায়েন্স থেকে শুরু করে বিপণন বিজ্ঞাপন সবকিছুই চিত্তাকর্ষক করে তোলা যায় সুনিপুণ গল্প বলার মাধ্যমে।
সংলাপ তৈরি
পান্ডুলিপি মানেই সংলাপ আকারে পুরো ধারা বর্ণনা করা। ইউটিউবের শর্ট ফিল্ম থেকে শুরু করে মনোলগ পর্যন্ত সবকিছু হবে কথোপোকথন আকারে। এটি স্ক্রিপ্ট রাইটারদের মূল হাতিয়ার, কারণ এর মাধ্যমে একটি দৃশ্য কতটুকু প্রাণবন্ত তা ফুটে ওঠে।
প্রুফরিডিং ও রিরাইটিং
যেকোনো লেখা শেষ হওয়ার পর প্রতিটি লেখকের উচিত তা কয়েকবার পড়ে দেখা। এ সময় ব্যাকরণজনিত নানা ছোট খাটো ভুল ধরা পড়ে। অনেক কষ্ট করে একটি পান্ডুলিপি শেষ করার পরেও ক্লায়েন্টের কাছে তা নির্ভুলভাবে পরিবেশন না করা গেলে সব কষ্টই বৃথা। অনেক ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট নতুন শর্ত জুড়ে দিলে সামগ্রিক লেখায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিবর্তন আনতে হয়। তাই লেখককে রিরাইটিংয়ে দক্ষ হওয়া জরুরি।
ধৈর্যশক্তি
যে মাধ্যমের জন্যই হোক না কেন, পুরো একটি পান্ডুলিপি শেষ করা বেশ ধৈর্য্যের কাজ। প্রথমত সৃজনশীল এই কাজে জোর-জবরদস্তির কোনও সুযোগ নেই। এরপর শেষ করার পর পুনরায় তার মান যাচাই করাতেও যথেষ্ট অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। তাই লেখার কাজে ধৈর্য্যশীলতার কোনও বিকল্প নেই।
ইউটিউব ভিডিওর জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটিং কীভাবে শিখবেন
আপনার যদি এ ব্যাপারে একদমি ধারণা না থাকে, তাহলে প্রাথমিক তত্ত্বগুলো শেখার জন্য ভালো কোনও কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। কোর্স করার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে পুরো বিষয়টি সুন্দরভাবে ছকে বাঁধা থাকে এবং এভাবে সহজ থেকে জটিল স্তরের দিকে যাওয়া হয়।
এখানে অনুশীলন করার পাশাপাশি সমমনার অন্যান্য লোকদের সঙ্গে মন বিনিময়ের মাধ্যমেও জ্ঞানার্জন করা যায়। এছাড়া অনলাইন কোর্সেও অংশ নেয়া যেতে পারে। স্কিলশেয়ার ও ইউডেমির মত প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে আপনি অনায়াসেই স্ক্রিপ্ট রাইটিং-এর প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন।
সৃজনশীল বিষয়বস্তু অধ্যয়ন
সৃজনশীলতাই যখন মূল চাবিকাঠি, তখন এর যথাযথ চর্চা হওয়া আবশ্যক। এর জন্য ইউটিউবসহ অন্যান্য সাইটগুলোতে ব্যতিক্রম ধারার কাজগুলো দেখতে পারেন। বিশেষ করে ঘরে বসে কোনও কিছু তৈরি, দীর্ঘ সময়ের কোনো কাজের স্বল্পকালীন সহজ সমাধান প্রভৃতি কন্টেন্টগুলো অধ্যয়ন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তথ্যচিত্রগুলো সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে।
লেখালেখির অভ্যাস গড়ে তোলা
যেকোনো অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার উপর্যুপরী অনুশীলনের কোনও বিকল্প নেই। আপনার প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিদিনি কিছু না কিছু লিখুন। প্রিয় বই, মুভি, পর্যটন এলাকা, রান্না প্রভৃতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নিয়মিত আপনার মতামত ব্যক্ত করুন। এভাবে লেখালেখির সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া এক সময় নতুন নতুন শব্দ, বাক্য; এমনকি নতুন ধারণা সৃষ্টির দিকে ধাবিত করবে।
অনলাইন গবেষণা ও অনুশীলন
কোনো কিছু শেখার সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি হলো স্বশিক্ষা বা নিজে নিজে শেখা। বর্তমানে সার্চ ইঞ্জিনগুলো যেন হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সমগ্র পৃথিবীকে। অধ্যয়নের জন্য সেরা কন্টেন্টগুলো খুঁজে বের করুন। বিশেষ করে বিখ্যাত নিউজ সাইটগুলো ব্রাউজ করুন। প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড বা জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারদের কাজগুলো দেখুন। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করে তা অনুশীলন করুন।
স্ক্রিপ্ট রাইটারদের বিভিন্ন গ্রুপে সক্রিয় থাকা
প্রতিটি পেশার মতো এখানেও যোগাযোগের দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। নতুন কোনও পেশা না হওয়ায় আপনি অনায়াসে অনেকগুলো গ্রুপ বা ফোরাম পেয়ে যাবেন ইন্টারনেট জুড়ে। সেখানে মন্তব্য বা আলোচনাগুলো পড়ুন। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কোন স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। তখন তাকেই আপনি বিভিন্ন সময়ে আপনার মেন্টর হিসেবে পাবেন।
সামাজিক সাইটটির অন্যান্যদের সঙ্গে স্ক্রিপ্টের নানাদিক নিয়ে কথা বলুন। এটি শুধু শিখনেই কাজে লাগে তা নয়; গল্পের নতুন ধারণা পেতেও সাহায্য করে।
শেষাংশ
ইউটিউব ভিডিও স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের দক্ষতার প্রশ্নে উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। অবশ্য নিদেনপক্ষে এটি এক ধরনের লেখালেখিই বটে। তাই বৃহত্তর দৃষ্টে লেখালেখির জন্য অদম্য নেশার পাশাপাশি সৃজনশীলতা থাকা জরুরি। যোগ্যতাটি জন্মগত না হলেও কাজের প্রতি নিষ্ঠা একজন পুরোদস্তুর লেখক তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। আর ডিজিটাল ব্যবসাগুলোর উত্তোরোত্তর বিকাশের ফলে দ্রুত স্বচ্ছলতা প্রাপ্তির এক দারুণ উপায় হতে পারে স্ক্রিপ্ট রাইটিং।