বরগুনায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে
সাগরের কূলঘেঁষা ছোট্ট এক জনপদের নাম বরগুনা। সাগর-বনের মিলনে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে এ জনপদে। জোয়ার-ভাটার চিরায়ত চলন আর ম্যানগ্রোভ বন বরগুনা জেলাকে করেছে প্রাণবন্ত। আছে লালদীয়া ও আশার চরের শুঁটকিপল্লি, ছোট-বড় একাধিক দ্বীপ-চর, রাখাইন নৃগোষ্ঠী, মোগল স্থাপনা বিবিচিনি শাহি মসজিদ, বহমান পায়রা, বিষখালী নদীসহ ভ্রমণের অনেক কিছু। বরগুনা ভ্রমণে আপনার মনে হবে এ যেন সৈকতের এক সবুজ জনপদ।
টেংরাগিরি ইকোপার্ক
বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সোনাকাটায় অবস্থিত টেংরাগিরি ইকোপার্ক। এটি ফাতরার বন নামেও পরিচিত। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের একটি অংশ দেখা যাবে টেংরাগিরি ভ্রমণে। শুধুই বন-বনানীর সবুজ সান্নিধ্য নয়, এখানে দেখা মিলবে হরিণ, কুমির, সাপ, শূকর, কাঠবিড়ালিসহ নানা বন্যপ্রাণী। ইটের তৈরি রাস্তা ধরে হেঁটে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছালে দেখা যাবে তীরে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ। বনের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খালগুলোতে দেখা মিলবে জলজ প্রাণীর খুনসুটি। ম্যানগ্রোভ বন, সৈকত আর ইকোপার্কের বন্যপ্রাণীর বিচরণ, এসব একসঙ্গে পেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সেখানে।
শুভসন্ধ্যা সৈকত
শুভসন্ধ্যা সৈকতটি পর্যটকমহলে অন্যতম ভ্রমণ আকর্ষণের নাম। তালতলী টেংরাগিরি ইকোপার্কের খুব কাছে ভ্রমণকেন্দ্রটির অবস্থান। সৈকতে দাঁড়ালেই সম্মুখ সমুদ্রের উন্মুক্ত ঢেউ, শীতল বাতাস পর্যটকের মনে এনে দেয় অনাবিল শান্তি। সাগর-মোহনার দীর্ঘ ঝাউবন স্থানটিকে করে তুলেছে আরো মুগ্ধকর। প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি দিনে সেখানে জ্যোৎস্না উৎসবে মিলিত হয় অগণিত মানুষ। দেশের একমাত্র জ্যোৎস্না উৎসবের এ কেন্দ্রটি সারা বছর পর্যটককে ভ্রমণতৃপ্তি দিতে প্রস্তুত থাকে।
তালতলী রাখাইন পল্লি
বরগুনা ভ্রমণ অনুষঙ্গ হিসেবে ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে তালতলীর রাখাইন পল্লিগুলো। রাখাইনদের বসবাস ও তাঁদের জীবনচিত্র সম্পর্কে যাঁরা জানতে আগ্রহী, তাঁরা অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন তালতলী রাখাইন পল্লি থেকে। সেখানে মোট ২৩টি পল্লিতে বাস করছে রাখাইন সম্প্রদায়। তাঁদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, প্রাচীন উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তিগুলো পর্যটককে ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দেয়।
হরিণঘাটা বনাঞ্চল
বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত হরিণঘাটা বনাঞ্চল। বন-বনানীর এই সবুজ অরণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুপরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র। বনটিকে ইকোট্যুরিজমের আওতায় এনে দর্শনার্থীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে নির্মাণ হয়েছে আঁকাবাঁকা একটি ফুট ট্রেইল (পায়ে হাঁটাপথ), দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত সেতু, সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার, বিশ্রামঘরসহ নানান কিছু। এ বনের হাজারও গাছ, প্রকৃতির বুকে সমৃদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণের অনুভূতি দেবে। এ ছাড়া হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালি, মেছোবাঘ, ডোরাবাঘ, শজারু, শিয়াল, গুইসাপসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৯০ প্রজাতির পাখি দেখার সুযোগ রয়েছে।
লালদিয়া ও শুঁটকিপল্লি
হরিণঘাটা বনভূমি যেখানে সৈকতে মিশেছে, সেখানে পৌঁছালে মনে হবে এ যেন অবাক সৌন্দর্যের আরেক পৃথিবী। এই পৃথিবীর নাম লালদিয়া। পায়ে হেঁটে বন পাড়ি দিয়ে অনেকের পক্ষে যখন লালদিয়া পৌঁছানো সম্ভব নয়, তখন স্বাচ্ছন্দ্যের বিকল্প উপায় ছোট ছোট ট্রলার। হরিণঘাটা বনকেন্দ্র থেকে ছোট ছোট একাধিক নদী লালদিয়ার চর হয়ে মিশেছে সাগরের মোহনায়। এসব নদী বয়েই পৌঁছাতে হয় লালদিয়ার চরে। নদীপথ ধরে এগোনোর সময় ঢেউয়ের প্রতিযোগিতা আর রংবেরঙের কাঁকড়ার খেলা দেখলে মনে হবে বৃথা নয় এই ভ্রমণ। নদীগুলো দেখলে মনে হবে, সবুজ কোনো আর্টপেপারে নরম তুলিতে আঁকা নয়নাভিরাম দৃশ্য।
শীতের মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর আগমন ঘটে চরে। তখন সাগর-মোহনায় গড়ে তোলা হয় অস্থায়ী একাধিক শুঁটকিপল্লি। এ ছাড়া অতিথি পাখির আগমনে মুখর হয় লালদিয়ার সম্মুখ পানের দক্ষিণা সৈকত। পাশাপাশি দেখা মেলে একাধিক শ্রেণির জলজ প্রাণী। এই চরের শুঁটকিপল্লি, পাখপাখালি আর সবুজ সৈকত মিলে গড়ে তুলেছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
পায়রাপাড়
একপাশে বরগুনা সদর উপজেলা, অন্যপাশে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার অবস্থান। জেলাটির মাঝ থেকে বয়ে চলেছে পায়রা নদী। সেই পায়রাপাড়ে সন্ধান মেলে ভ্রমণ-প্রশান্তি। প্রকৃতির ইচ্ছায় সেই পায়রাপাড়ে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক ভ্রমণযোগ্য স্থান। গোলবুনিয়া, পালের বালিয়াতলি, গোরাপদ্ম ছাড়াও আরো অনেক স্থান পর্যটকের মন ভরিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। পায়রাপাড়ে দেখা মিলবে ছৈলা, করমজা, খলিসা, গোলপাতাসহ নানা প্রজাতির গাছ। দেখা মিলবে মাঝি-নৌকার মিতালি। জেলেদের ইলিশ শিকার কিংবা শিশু ও নারীর জাল টেনে মাছ ধরার দৃশ্য।
এ ছাড়া বরগুনা ভ্রমণের মাধ্যমে পর্যটক দেখতে পাবেন বিহঙ্গ দ্বীপ, পাথরঘাটা মৎস্যবন্দর, টুলুর চর, মাঝের চর, একাধিক জেলেপল্লিসহ অনেক কিছু।
বরগুনা ভ্রমণের প্রকৃত স্বাদ নিতে হলে ছুটে যেতে হবে এ জেলার প্রতিটি উপজেলায়। তাই কমপক্ষে দু-তিন দিনের সময় নিয়ে যেতে হবে। লঞ্চ কিংবা বাসে যেতে পারবেন বরগুনায়। জেলার প্রতিটি উপজেলা সদরে রয়েছে আবাসিক একাধিক হোটেল। সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। তবে যাঁদের অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ, তাঁরা তাঁবু নিয়ে জঙ্গলে রাত কাটানোর মজা নিতে পারেন। আর হ্যাঁ, বরগুনার স্পেশাল খাবার নদনদী কিংবা সমুদ্রের মাছ। নারকেলের ঝোল কিংবা হাঁসের মাংস দিয়ে রুটি-পিঠা এ জেলায় খুব সমাদৃত। এগুলো খেয়ে যেতে ভুলবেন না যেন।